ঢাকা: সবচেয়ে বিকশিত গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসে আগ্নেয়াস্ত্র সংরক্ষণ করা সেদেশের মানুষের মৌলিক অধিকারের সমতুল্য। সংবিধানে এই অধিকার রক্ষা করা হয়েছে খুব জোরালোভাবে।
মার্কিন সংবিধানের বিল অব রাইটসে আগ্নেয়াস্ত্র সংরক্ষণ ও তা বহন করার অধিকার রয়েছে। সংবিধানের প্রথম ১০টি সংশোধনীকে একত্রে বিল অব রাইটস বলা হয়। এর সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট বা দ্বিতীয় সংশোধনীতেই বন্দুক বা আগ্নেয়াস্ত্র সংরক্ষণের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
বন্দুক বা আগ্নেয়াস্ত্রকে যদি বিরাট ওয়াগনের (গাড়ি) সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে উন্মুক্ত, বিস্তৃত দিগন্তে সেই গাড়ি চালানোর নিয়মের আদতে বালাই নেই। বিপ্লবী ও প্রবর্তকদের হাতে দেশ গড়ার শুরুতেই তারা এই বন্যতাকে আপামর মানুষের সঙ্গে একাত্ম করেছেন। ধর্মকে মানুষ যেভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে, বন্দুককে মার্কিনিরা তেমনি ধ্যানজ্ঞান মনে করে।
বন্দুক নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কোনো আইনই অধিকাংশ মার্কিনীর কাছে খুব কল্কে পায় না। সম্প্রতি অ্যারিজোনার টুকসন হত্যাযজ্ঞের পর আমেরিকার বন্দুক সংস্কৃতির ব্যাপারে বিতর্ক নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। জ্যারেড লাফনারের মতো একজন উন্মাদের ছোড়া গুলিতে অ্যারিজোনার কংগ্রেস সদস্য গ্যাব্রিয়েল গির্ফোডস মাথায় মারাত্মক আহত হয়েছেন। একই ঘটনায় শিশুসহ ছয়জন নিহত হয়। এর আগেও এ রকম ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে হরহামেশাই ঘটতে দেখা গেছে।
সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্টে কাউকে কি সত্যিই ম্যাগাজিনে ৩০টি বুলেট রাখার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে? এটা জরুরি বিতর্ক হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে বারবার এর ফলাফল পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রাইফেল সংস্থার (এনআরএ) নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়েইন লাপিয়ের দুই বছর আগে ঘোষণা দেন: বন্দুক হাতে যার, আইন তার।
বন্দুক সংরক্ষণ আন্দোলনে ওল্ড ওয়েস্ট ঐতিহ্যেও ধারক বাহক অ্যারিজোনার স্থান সামনের সারিতে। গত বছর এ অঙ্গরাজ্যে একটি আইন পাস হয়: অ্যারিজোনার অধিবাসীরা গোপনে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে পারবে। এর আগে এমন আইন কেবল ছিল ভারমন্ট ও আলাস্কা অঙ্গরাজ্যে। অ্যারিজোনা তৃতীয় অঙ্গরাজ্য যেখানে এরকম আইন হলো। এর আরেকটি আইনে লোকজন পানশালায়ও আগ্নেয়াস্ত্র নেওয়ার অনুমতি পেয়েছে। তবে তা সুরাপানকালে প্রযোজ্য হবে না।
গ্যাব্রিয়েল গিফোর্ডসসহ অ্যারিজোনার বেশিরভাগ রাজনীতিকই সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্টের গোঁড়া সমর্থক। গির্ফোডস নিজেও আগ্নেয়াস্ত্রের মালিক। রিপাবলিকান দলের কংগ্রেস সদস্য ট্রেন্ট ফ্রাংকস একবার বলেন, ওয়াশিংটনের চেয়ে অ্যারিজোনায় আগ্নেয়াস্ত্র সংক্রান্ত সহিংসতা অত্যন্ত কম। অথচ ওয়াশিংটনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ওপর কড়াকড়ি রয়েছে। অস্ত্র বহন ও সংরক্ষণের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘অপরাধীরা সবসময় নিরস্ত্র লোকজনকে টার্গেট করে। ’ ফ্রাংকস নিজেও আগ্নেয়াস্ত্রের মালিক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অভিজাত ও সশস্ত্র এমন লোকের এ দৃষ্টিভঙ্গী জ্যারেড লাফনারের বেলায় খাটল না।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ১ শতাংশেরও কম। বাকি মৃত্যুর ঘটনাগুলো হচ্ছে, পরোক্ষ হত্যা, আত্মহত্যা ও দুর্ঘটনা। ২৩টি উচ্চ আয়ের দেশে পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব দেশে আগ্নেয়াস্ত্র সংক্রান্ত মৃত্যুর ৮০ শতাংশ ঘটনা ঘটে যুক্তরাষ্ট্রেই। আর পরোক্ষ খুনের ঘটনা অন্যান্য দেশের তুলনায় ২০ গুণ বেশি।
এরপরেও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন কয়েকটি প্রধান শহরে ছাড়া রাজনৈতিক মনোযোগ পেতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনটি অঙ্গরাজ্য ছাড়া সবকটিতেই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের কার্যকারিতা নেই। এনআরএর তথ্য মতে, ২৫টি অঙ্গরাজ্য ‘আপনার বাড়ি, আপনার দুর্গ’ আইন চালু করেছে। এ আইন অনুযায়ী নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় বিনা উস্কানিতে যে কাউকে গুলি করে মেরে ফেলার অধিকার দেওয়া হয়েছে। আর মাত্র ১০টি অঙ্গরাজ্যে জনসম্মুখে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন রয়েছে।
এর মধ্যে বিল কিনটন প্রশাসন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কিছু চেষ্টা করেছে। কংগ্রেসে ১৯৯৩ সালে ব্র্র্যাডি বিল পাস করা হয়। এতে অস্ত্র ক্রেতাদের মানসিক বৈকল্য আছে কি না তা যাচাই করার ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। কিন্তু আইন করার ফলে সেসময় মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্রাট প্রার্থীরা ধরাশায়ী হয়, হেরে যায়। এ থেকে বোঝা যায়, আগ্নেয়াস্ত্র বিরোধী অবস্থান রাজনৈতিক অঙ্গনে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই অবস্থান আগ্নেয়াস্ত্রপ্রেমী লাখ লাখ আমেরিকানের লালিত মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা করার শামিল। বেশিরভাগ মার্কিনীই মনে করে, আগ্নেয়াস্ত্র সংরক্ষণের সঙ্গে অর্থনৈতিক সুরক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই, এর সঙ্গে মানসিক বৈকল্যেরও কোনো যোগ নেই।
জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলেও একবার অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন আরোপ করা হয়। তবে রাজনৈতিক বিতর্কের মুখে ২০০৪-এ তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যিনি দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের পক্ষে লড়াই করেছেন। হোয়াইট হাউসে এসে তিনি তা কৌশলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। ওবামা এমনকি দুটো আইন করেছেন, যাতে জাতীয় উদ্যান ও ট্রেনে অস্ত্র বহন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
ব্র্যাডি ক্যাম্পেইন টু প্রিভেন্ট গান ভায়োলেন্স নামের একটি সংগঠনের প্রেসিডেন্ট পল হেলমেব জানিয়েছে, ‘এ ইস্যুতে আমরা খুব বেশি রাজনৈতিক মনোবল দেখিনি। ’ সংগঠনটি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের পক্ষে কাজ করে।
আগ্নেয়াস্ত্র সংক্রান্ত সহিংসতা
প্রতি বছর: প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের সহিংসতায় ৩১ হাজার দুইশ ২৪ জন মারা যায়। ১৭ হাজার তিনশ ৫২ জন আত্মহত্যা করে। খুন হয় ১২ হাজার ছয়শ ৩২ জন। আর হত্যা, হামলা, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা ও পুলিশি মধ্যস্থতা ইত্যাদি ঘটনায় লক্ষাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। ৬৮৩ শিশু-কিশোর আত্মহত্যা করে, মোট তিন হাজার ৬৭ জন শিশু-কিশোর অস্ত্র সহিংসতায় নিহত হয়। ৩৫১ জন পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
প্রতিদিন: আটজন শিশু-কিশোর এ ধরনের সহিসংতায় মারা যায়। আর হত্যা, হামলা, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা ও পুলিশি মধ্যস্থতা ইত্যাদি ঘটনায় ২৬৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়। প্রতিদিন ৮৬ জন নিহত হয়, এর মধ্যে খুন হয় ৩৫ জন।
টাইম সাময়িকী অবলম্বনে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১১