ঢাকা: চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, এমনকি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ‘বিভিন্ন ঢংয়ের উপঢৌকন’ দিয়ে ওষুধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট গ্লাক্সোস্মিথক্লিন (জিএসকে)! বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানটির শাখা কার্যালয়গুলো জড়িয়ে পড়ছে এমন দুর্নীতিতে।
গত বছর ফাঁস হওয়া এমন ‘উপঢৌকন’ কেলেঙ্কারিতে তোলপাড় শুরু হয়েছে গ্লাক্সোস্মিথে।
অনিয়ম-দুর্নীতি-অসামাজিক কার্যকলাপের খবর অবগতির ব্যাপারে খোদ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অসত্য বক্তব্যের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ায় গ্লাক্সোস্মিথের ভোক্তারা প্রতিষ্ঠানটির ওষুধ-সেবার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন।
সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়, গত বছরের মার্চে গ্লাক্সোস্মিথের চীন শাখার সাবেক তিন নির্বাহী প্রধানের বিরুদ্ধে ‘ঘুষ ও নারী’ লেনদেনের অভিযোগ উঠে। আর এই অভিযোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে এক নির্বাহী প্রধানের সঙ্গে তার কথিত বান্ধবীর (চীনা নাগরিক) গোপন আলাপ ফাঁসের পর।
রেকর্ডকৃত গোপন আলাপ সেসময় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠানো হলেও বিষয়টি ধামাচাপা দিতে গ্লাক্সোস্মিথের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পক্ষ থেকে বলা হয়, এ বিষয়ে প্রধান কার্যালয় অবগত নয়।
রোববার গ্লাক্সোস্মিথের যুক্তরাজ্যস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়, সাংহাইয়ের অ্যাপার্টমেন্টে অবস্থানের সময় গ্লাক্সোস্মিথের স্থানীয় নির্বাহী মার্ক রেইলের শয়নকক্ষে রেকর্ডকৃত তার সঙ্গে চীনা বান্ধবীর গোপন আলাপের টেপ গত বছরের মার্চেই প্রধান কার্যালয়ের শীর্ষ নির্বাহীদের কাছে পৌঁছে।
ওই গোপন আলাপসহ সংশ্লিষ্ট কিছু ঘনিষ্ঠ সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, নিজেদের ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের কয়েক কোটি মার্কিন ডলার ‘উপঢৌকন’ দিতে অধীনস্থ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন মার্ক রেইলি। এমন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বেইজিংয়ের ঝেং গুয়েই ও সাংহাইয়ের ঝাও হংজিয়ানও।
সংবাদ মাধ্যমগুলো আরও জানায়, আলাপ ফাঁস হওয়ার পর তার নমুনা (কপি) প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়ে শয়নকক্ষে ক্যামেরা স্থাপনের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে অলক্ষ্যে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় স্থানীয় গ্লাক্সোস্মিথ। পরে তদন্তে ব্যর্থ পিটার হামফ্রেইজ ও তার স্ত্রীকে আটক করে চীনা পুলিশ, তারা এখনও আটক রয়েছেন।
গ্লাক্সোস্মিথ কর্তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ গত ১৪ মে ফের প্রকাশ্যে তোলে চীনের হুনান প্রদেশের পুলিশ।
এরই মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে স্থানীয় প্রশাসন। যদিও দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে ফাঁস হওয়া আলাপের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে মুখ খোলেনি কোনো পক্ষ।
তবে চীনা পুলিশ মনে করেন, ২০০৭ সালের পর থেকে গ্লাক্সোস্মিথ অন্তত সাতশ’ মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঘুষ দিয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা ছিল আদম ব্যবসায়ীদের (ট্রাভেল এজেন্সির কর্মকর্তা) মতো, যারা ‘উপঢৌকন’ হিসেবে সংশ্লিষ্টদের কাছে নারীও পাঠাতেন!
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়, গ্লাক্সোস্মিথের এ কেলেঙ্কারি দেশটিতে নিযুক্ত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। শুধু চীনে নয়, এ কেলেঙ্কারি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও যে কোনো স্থানে অস্বস্তিতে ফেলবে।
গত বছর এমন অভিযোগ ওঠার পর চীনা সরকার জানায়, ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতির তদন্ত করবে তারা। ঘোষণা অনুযায়ী, গত আগস্টেই গ্লাক্সোস্মিথের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অ-ব্যবসায়ীসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে চীন সরকার।
স্থানীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার কর্মকর্তারা মনে করেন, গ্লাক্সোস্মিথের সর্বত্র দুর্নীতি ছড়িয়ে গেছে এবং তারা নিজেদের ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লেখার জন্য মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে চিকিৎসকদের অর্থ দিয়ে ‘অনিয়মের নিয়ম’ জারি করেছে।
চীনের জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গ্যাও ফেং বলেন, গ্লাক্সোস্মিথই প্রধান অপরাধী। এটাকে অপরাধী সংগঠনের মতো মনে হচ্ছে, এখানে সবাই বস। এই দুর্নীতির খেলায় গ্লাক্সোস্মিথ গডফাদারের ভূমিকায় রয়েছে।
গ্লাক্সোস্মিথের ভোক্তাদের কাছে সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আলাপ ফাঁসের পর সেটা গত বছরের মার্চেই প্রধান কার্যালয়ে পৌঁছানো হলেও জুলাইয়েই গ্লাক্সোস্মিথের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু উইটি দাবি করেন, চীনে নিযুক্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের লন্ডনস্থ প্রধান কার্যালয় অবগত নয়। তাছাড়া, ওই ঘটনা তদন্তের আশ্বাস দেন তিনি।
ভোক্তারা মনে করছেন, গ্লাক্সোস্মিথ তখনকার ঘটনা ধামাচাপা দিতেই ‘কৌশল’ নিয়েছে, আর এমন অতি-কৌশলই প্রতিষ্ঠানটির ওপর জনআস্থায় ধ্বস ফেলবে!
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩০ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০১৪