হাভানা: কিউবায় একটি সাহসী ও নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। সেখানে খরিদ্দারই রাজা।
নাপিতটির গায়ে নোংরা সাদা কোট। বয়স চল্লিশ বা এরকম কিছু একটা। চুল কাটার কাঁচিটা রেখে একটি সিগারেট জ্বালাল। এরপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আমার তো মনে হয় ঠিকই আছে। বুঝতে পারছি না, তুমি কী বলছ। ’
বিভিন্ন কোণ থেকে ওই তরুণ খরিদ্দার তার মাথা পরখ করতে লাগল। প্রত্যেকবার দেখার সময় আগের চেয়ে খারাপ মনে হলো তার কাছে। অত্যন্ত কষ্টে সে বলে ফেলল, ‘মনে হচ্ছে এটি (মাথা) একটি টেনিস বল। ’ নাপিত আরেকবার চুল আঁচড়িয়ে হাত প্রসারিত করে বলল, ‘চল্লিশ পেসো (কিউবার মুদ্রা) দাও। শুভ হোক তোমার দিন। ’ হাভানার উপকণ্ঠে নেপটুনো স্ট্রিটের দৃশ্য এটি।
সরকারি কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার ঘোষণা করেছে, ১০ লাখেরও বেশি সরকারি কর্মচারিকে ছাঁটাই করা হবে। ১৯৬০ এর দশকের পর থেকে দ্বীপ দেশটিতে এটিই সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক পদক্ষেপ।
কিউবার সরকারি শ্রম ফেডারেশন ঘোষণা করেছে, ‘বিভিন্ন কোম্পানি, উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সেবাখাত ও বাজেটের অধীনে থাকা বিভিন্ন সেক্টরের বিশাল বেতন কাঠামো ও ক্ষতি আমাদের রাষ্ট্র অব্যাহত রাখতে পারবে না ও উচিতও না। ’
ওই ঘোষণায় আরও বলা হয়, ‘অরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চাকরির ক্ষেত্র বাড়ানো হবে, এর মধ্যে ভূমি ইজারা, সমবায় ও স্বকর্মে উৎসাহিত করা হবে। এগুলোতে লাখ লাখ শ্রমিকদের নিয়োজিত করা হবে। ’
প্রকৃতপ্রস্তাবে, গত এপ্রিলেই নাপিত ও চুল পরিচর্যাকারীদের ব্যক্তিখাতে রূপান্তর করার মধ্য দিয়ে এই পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। সাবেক সরকারি চাকরিজীবীদের ৮৫ শতাংশ--যারা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের জন্য কাজ করত--তাদের সবার হাতে সব সেলুনের দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হয়েছে। খরিদ্দারের কাছে তারা ইচ্ছামতো চার্জ ধার্য করবে এবং কর দেবে।
অংশীদারমূলক বাজার বিস্তৃত করা দূরে থাক, খরিদ্দারকে ভালো সেবা দেওয়াও কিউবায় অপরিচিত। সংবাদপত্র গার্ডিয়ানকে ওই নাপিত বলেন, ‘আমি এর দায়িত্ব নিতে চাই না। কিভাবে এটা থেকে লাভ হবে তা আমি কেমন করে জানব? আমি সরবরাহকারীদের ঋণ পরিশোধ করব কীভাবে?’
এরকম হোক আর না হোক, চাকরি থেকে বিদায়ের পর কিউবার অনেক নাগরিকই এরকম প্রশ্ন করতে থাকবেন। বার্তাসংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-এর কাছে ফাঁস হওয়া ২৬ পৃষ্ঠার পার্টির নথি থেকে জানা গেছে, খরগোশ পালন, ভবন রং করা, ইট তৈরি, আবর্জনা সংগ্রহ ও হাভানার উপসাগরে নৌযান চালানো ইত্যাদি ছাঁটাই হওয়া কর্মচারিদের জন্য নতুন কাজ হতে পারে।
কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিখাতে সমবায় গঠন, অন্যগুলোর ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানিগুলো ও যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ব্যবসায় উৎসাহিত করা হবে। কিছু ক্ষেত্রে ছোট ব্যবসা চালু করারও উৎসাহ দেওয়া হবে।
কমিউনিস্ট পার্টির নথিতে স্বীকার করা হয়েছে, অভিজ্ঞতার অভাব, অপর্যাপ্ত দক্ষতা ও উদ্যোগ ইত্যাদির ফলে এই পদক্ষেপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।
গত বছর বেকারত্ব ছিলো ১ দশমিক ৭ শতাংশ, যাদের সরকারিভারে ২০ মার্কিন ডলার করে ভাতা দেওয়া হতো। সেই সঙ্গে আছে রেশনের একটি বই, বিনা পয়সায় স্বাস্থ্য চিকিৎসা ও শিক্ষা। কিউবার অনেক নাগরিক কম পরিশ্রম করেন। তাদের ক্ষেত্রে পুরনো একটি প্রবাদ বেশ মানানসই: ‘তারা আমাদের পয়সা দেওয়ার ভান করে, আর আমরা কাজ করার ভান করি। ’ সমাজতান্ত্রিক মানুষ গড়ে তোলার জন্য চে গ্যেভারার স্বপ্ন কেবল নৈতিক বিষয়েই পরিণত হয়েছে। বৈষয়িক প্রণোদনা অনেক আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে বিস্তৃত আকারে সরকারি ঘোষণা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৮ সালে ভাই ফিদেল কাস্ত্রোর কাছ থেকে ক্ষমতা নেওয়ার পর রাউল কাস্ত্রো এমনই ভেবেছিলেন। গত মাসে জাতীয় সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই ধারণা মুছে ফেলতে হবে যে, বিশ্বে কিউবাই একমাত্র দেশ যেখানে মানুষ কোনো কাজ না করেই বেঁচে থাকতে পারে। ’
ওই নথির তথ্য অনুযায়ী, চিনি, গণস্বাস্থ্য, পর্যটন ও কৃষি মন্ত্রণালয়েরর শ্রমিকরা ছাঁটাইয়ের প্রথম পর্যায়ে পড়বেন। সর্বশেষ পর্যায়ে আছে, বেসরকারি বিমান চলাচল ও পররাষ্ট্র সম্পর্ক ও সমজাসেবা মন্ত্রণালয়।
বিকাশ-ব্যাহত বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করতে কিউবার নাগরিকদের পশুপালন, শাকসব্জি চাষ, ট্যাক্সি চালনা, গাড়ি মেরামত, মিষ্টি ও শুকনো ফল তৈরি এবং ভবন নির্মাণ কাজ ইত্যাদিতে উৎসাহিত করা হবে।
হাভানায় আয়োজিত একটি মধ্যাহ্ণভোজ শেষে আটলান্টিক ম্যাগাজিনের প্রতিনিধি ড্যানিয়েল গোল্ডবার্গকে ফিদেল কাস্ত্রো বলেন, ‘কিউবার মডেল এমনকি আমাদের জন্যও কাজ করছে না। ’
একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কিউবার পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ জুলিয়া সোয়েইগ। তিনি বলেন, কাস্ত্রো তার দেশের নাগরিকদের উদ্দেশে এই মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, ‘তিনি বলতে চেয়েছিলেন, যদিও আমরা আমাদের মডেল পরিবর্তন করছি। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা মার্কিন পুঁজিবাদ আমদানি করছি। ’
সোয়েইগ বলেন, কাস্ত্রোর ঘন ঘন জনসম্মুখে এসে মন্তব্য করা স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার। তার মন্তব্য উত্তরসূরি ভাই রাউল কাস্ত্রোর অর্থনৈতিক সংস্কার কৌশলের সঙ্গে বেশ যুৎসই। দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময়: ১৭১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১০