ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মাদরাসার শৌচাগারে দুই ছাত্রীর মরদেহ, এলাকায় তোলপাড়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০২২
মাদরাসার শৌচাগারে দুই ছাত্রীর মরদেহ, এলাকায় তোলপাড়

নরসিংদী: নরসিংদীর শেখেরচরের কুড়েরপাড়ের জামিয়া কওমিয়া মহিলা মাদরাসার শৌচাগার থেকে মাইশা আক্তার (১০) নামে এক ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (০১ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টায় শৌচাগারের ভেন্টিলেটরের গ্রিলের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় মাইশা আক্তারকে উদ্ধার করা হয়।

 

পরে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মাদরাসা কর্তৃপক্ষ একে আত্মহত্যা দাবি করলেও নিহতের স্বজনদের দাবি, এটি হত্যাকাণ্ড।

মাইশা আক্তার সদর উপজেলার মাধবদী থানার ভগীরথপুর এলাকার ডাইং শ্রমিক নেছার উদ্দিনের মেয়ে। সে মাদরাসাটির আবাসিক ছাত্রী হিসেবে মক্তব ২য় শ্রেণিতে পড়তো।

এর আগে ১৯ অক্টোবর বিকেলে একই মাদরাসার অন্য একটি শৌচাগার থেকে আফরিন আক্তার (১৬) নামে আরও এক ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে।  

নিহত আফরিন আক্তার মাধবদীর দড়িগাজীরগাঁও এলাকার ডালিম মিয়ার মেয়ে ও মাদরাসাটির আলিম প্রথম বর্ষের (উচ্চ মাধ্যমিক) শিক্ষার্থী ছিল।

দেড় মাসের মধ্যে মাদরাসাটির শৌচাগার থেকে দুই ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক এবং অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। এ নিয়ে শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ঘটনার সঠিক তদন্ত ও মাদরাসা বন্ধের দাবি তুলে বিক্ষোভ করেছে এলাকাবাসী।

জানা যায়, মাদরাসাটিতে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে আসা শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রথম শ্রেণি থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ আছে। শিক্ষার্থী সংখ্যা ৮৫০। এর মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থী ৪৫০ জন। পুরুষ শিক্ষক আছেন ৯ জন ও নারী শিক্ষক ২২ জন। নারী ও পুরুষ গার্ড আছেন ২ জন করে। কেউ কেউ এখানে থাকেন আবার কেউ কেউ নির্ধারিত সময়ে দায়িত্ব পালন করে চলে যান।

মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেলে আসরের নামাজ পড়ছিল সবাই। ওই সময় মাদরাসার ভেতর থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ পাওয়া যায়। ভয়ে ও আতঙ্কে ছাত্রীরা সব ছোটাছুটি করছিল। পরে কয়েকজন শিক্ষক ওই শৌচাগারের ভেতরে গিয়ে দেখেন, মাইশা তার ওড়না দিয়ে ভেন্টিলেটরের রডে ঝুলে আছে। ওই অবস্থা থেকে নামানোর পর দেখা যায়, তখনও সে জীবিত। পরে তাকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে যাওয়া হয়। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে নেওয়ার পরপরই কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত মাইশার পরিবারের সদস্যরা বলছেন, বৃহস্পতিবার সকালে বাবা নেছার উদ্দিন ওই মাদরাসায় গিয়ে দুপুরে খাওয়ার জন্য মাইশার হাতে ঘরে রান্না করা খাবার তুলে দেন। দুপুরে পরিবারটির সবাই পলাশের ঘোড়াশালে আত্মীয় বাড়িতে দাওয়াত খেতে যান। সেখানে থাকা অবস্থাতেই বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বাবা নেছার উদ্দিনের মোবাইলে মাদরাসার এক হুজুরের কল আসে। তিনি তাকে জানান, মাইশাকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে, আপনি দ্রুত আসেন। পরে মাইশার মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান। সেখানে গিয়ে মাইশাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। এ সময় তার কপাল ও গালসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান তারা।

মাইশার বাবা নেছার উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, মাদরাসার ভেতরে কিভাবে কি হয়েছে, আমরা কিছুই জানি না। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আমাকে ফোন করে মাদরাসার এক শিক্ষক জানান, মাইশাকে অসুস্থ অবস্থায় নরসিংদী সদর হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে, আপনি দ্রুত আসেন। আমি সেখানে গিয়ে তাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই।  

তিনি আরও বলেন, নিজে দেখেছি, নার্সরাও জানিয়েছেন, কপাল ও গালসহ তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন আছে। আমাদের ধারণা, তাকে আঘাত করে হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পরিবারের অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে আমি মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। অথচ সকালেও মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তার হাতে খাবার দিয়ে এসেছিলাম।

অভিযোগ তুলে নিহতের মা রুমা বেগম বলেন, ১০ বছরের একটি শিশু কিভাবে গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করতে পারে? আমার মেয়েকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। তার সারা শরীরে আঘাতের চিহ্নই এর প্রমাণ। মাদরাসার হুজুররাই এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই।

নরসিংদী সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) মোস্তফা কামাল উদ্দিন খান বলেন, শিশুটিকে মৃত অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার গলায় ফাঁসের চিহ্ন ছাড়াও শরীরের কয়েক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে ঠিক কি ঘটেছে, তা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর বিস্তারিত বলা যাবে।

মাইশা আত্মহত্যা করেছে দাবি করে মাদরাসাটির অধ্যক্ষ মুফতি আহসানুল্লাহ বলেন, ওই ছাত্রী নিজের ওড়নার সাহায্যে শৌচাগারের ভেন্টিলেটরের রডে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে।  

ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেন, এত অল্পবয়সী একটি শিশু কেন আত্মহত্যা করলো- তা খতিয়ে দেখতে গিয়ে জানতে পেরেছি, তাকে সঙ্গে না নিয়ে বাবা-মাসহ পুরো পরিবার ঘোড়াশালে আত্মীয়-বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিল। এতে কষ্ট পেয়ে মাইশা আত্মহত্যা করে থাকতে পারে। এর আগে তাকে স্বাভাবিকই থাকতে দেখেছে সবাই। সকালে তার বাবা এসে হাতে খাবার দিয়ে গিয়েছিল, দুপুরে অনুষ্ঠিত মৌখিক পরীক্ষায়ও অংশ নিয়েছে সে।

পরপর দুই ছাত্রীর মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মুফতী আহসানুল্লাহ বলেন, গত ১৯ অক্টোবর আত্মহত্যা করা আফরিন আক্তারের বিষয়ে তার পরিবারই কিন্তু স্বীকার করেছে যে, সে মাদরাসায় আসতে না চাওয়ায় বাবা-মা মারধর করেছিল। জোর করে তাকে মাদরাসায় দিয়ে গিয়েছিল বাবা। গেটের সামনেই তাদের কথোপকথন আমরা জেনেছিলাম। মেয়ে বলছিল, জোর করে মাদরাসায় দিয়ে গেলে আমি আত্মহত্যা করব। বাবা বলছিলেন, মরলে এখানেই মর, লাশ এসে আমি নিয়ে যাব। এরপরই ওই ছাত্রী মাদরাসার একটি শৌচাগারে নিজের ওড়না ভেন্টিলেটরে পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।

এ বিষয়ে মাধবদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রকীবুজ্জামান বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেই খবর পেয়ে সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একেএম শহিদুল ইসলাম সোহাগসহ আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দুই পক্ষের বক্তব্য শুনেছি। শুক্রবার দুপুরে নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে শিশুটির লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে।

এর আগেও মাদরাসাটির শৌচাগারে আরেক ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল উল্লেখ করে ওসি বলেন, এই ঘটনায় লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০২২
এসবি/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।