ঢাকা, রবিবার, ১৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৩ আগস্ট ২০২৫, ০৮ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

চাকরির কোটা আন্দোলন যেভাবে হাসিনার পতন ঘটালো

ফাহিম হোসেন, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭:২৪, আগস্ট ৩, ২০২৫
চাকরির কোটা আন্দোলন যেভাবে হাসিনার পতন ঘটালো হাসিনা সরকারকে উৎখাতের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এভাবেই উল্লাস করে জনতা

চব্বিশের ৩ আগস্ট বিকেল। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে।

মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সেই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে নাহিদ ইসলাম বললেন, আমাদের ৯ দফা দাবি ‘এক দফায়’ পরিণত হয়েছে। সেই এক দফা হলো শেখ হাসিনার সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-জনতার স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে পুরো এলাকা।

এই স্লোগান দমনে রাজধানীসহ সারাদেশে চলল গুলি। অনির্দিষ্টকালের জন্য জারি হলো কারফিউ। বন্ধ হলো মোবাইল ইন্টারনেট। সংঘর্ষে দেশ পরিণত হলো রণক্ষেত্রে। টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, গুলি, রক্ত, লাশ—সর্বত্র একই চিত্র।

কিন্তু দমিয়ে রাখা গেল না ছাত্র-জনতাকে। দমন-পীড়নের বিপরীতে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধের মুখে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবসান ঘটে দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের। বছর ঘুরে জুলাই আসতেই সেই স্মৃতি যেন এখনো তরতাজা হয়ে ধরা দেয় ছাত্র-জনতার কাছে।

মূলত আন্দোলনের শুরুটা হয় সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে। সরকারের দমন-পীড়নই সেই আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানের দিকে ঠেলে দেয়।

সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করে ৫ জুন হাইকোর্টের রায়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী আন্দোলন শুরু করেন। দলনিরপেক্ষ ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির নেতারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে একটি প্লাটফর্ম তৈরি হয় এবং শিক্ষার্থীরা এর ব্যানারে নানা কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। সরকারকে স্মারকলিপি প্রদান, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে জনসংযোগ করার কাজ করেন সংগঠকরা। কিন্তু সরকার থেকে শিক্ষার্থীদের কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

১ জুলাই
কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্র সমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহার আহ্বান জানানো হয়। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে তিন দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।

৬ জুলাই
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ছাত্রধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন। এর নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’। মূলত এদিন থেকেই সরকারের বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করে।

৭ জুলাই
শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অভিনব কর্মসূচি শুরু করেন, যা আন্দোলনকে নতুন রূপ দেয়। এসময় তারা চার দফা থেকে সরে এসে নির্বাহী বিভাগের কাছে কোটা সংস্কার করে সংসদে আইন পাসের এক দফা দাবি জানান। ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। প্রতিদিন ৫-৬ ঘণ্টা অচল হয়ে পড়ে রাজধানী।

৯ জুলাই
সারা দেশে সড়ক ও রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ব্লকেড অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা। এদিকে কোটা বহাল রেখে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে আইনজীবীর মাধ্যমে পক্ষভুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী।

১০ জুলাই
সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন হয় না। এটা আজকে না, আমি যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছিলাম, তখন একটি মামলায় বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন করা যায় না। এটি সঠিক পদক্ষেপ না। ’

১১ জুলাই, বৃহস্পতিবার
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছেন। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি। সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষার্থীরা ‘লিমিট ক্রস’ করে যাচ্ছেন।

১৪ জুলাই
চীন সফর নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা ও নাতিপুতি’ বলে কটাক্ষ করেন। এর প্রতিবাদে রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে হাসিনার কটাক্ষের প্রতিবাদ জানান আন্দোলনকারীরা

১৫ জুলাই
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান দিচ্ছেন, তাদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বেন বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। তারা ছাত্রীসহ অনেক শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পেটাতে থাকে, যার ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই হামলা অনেক শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে আহত হন। আন্দোলন নতুন মোড় নেয়।

১৬ জুলাই
কোটা ইস্যুতে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধসহ সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। রংপুরে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। দুই হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকা নিরস্ত্র সাইদের বুকে পুলিশের মুহুর্মুহু গুলি ছোড়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। সেদিন চট্টগ্রামে ওয়াসিমসহ মোট ছয়জনের মৃত্যু হয়।

এই পরিস্থিতিতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধের ঘোষণা দেয় তৎকালীন সরকার।

১৭ জুলাই
আগের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বের করে দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আগের দিন নিহতদের গায়েবানা জানাজা পড়তে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফেসবুকে এক বার্তায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে থাকার আহ্বান জানান।

সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি শীর্ষ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত কোটা ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান।

রাতে যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের গুলি করলে সংঘাতের সূত্রপাত হয়। তখন সেখানে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

১৮ জুলাই
শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তাদের হাত ধরে আন্দোলনে সাধারণ নাগরিকরাও নেমে পড়েন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশ হয়ে পড়ে প্রায় অচল।   মেরুল বাড্ডায় পুলিশ অবরুদ্ধ হলে পরে তাদের হেলিকপ্টারে উদ্ধার করা হয়। আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চলতে থাকলে বিক্ষুব্ধরা বিটিভি ভবনে আগুন দেন। পাশাপাশি সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুর হয়।

পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘাত সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ অনেকে হতাহত হন।

এই পর্যায়ে এসে সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি বলে জানান তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলন দমনে রাত ৯টা থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট।

১৯ জুলাই
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। রাজধানী ঢাকা ছিল কার্যত অচল, পরিস্থিতি ছিল থমথমে। আন্দোলনকারীরা ৯ দফা দাবি তুলে ধরেন। জানান, দাবি না মানা পর্যন্ত চলবে। রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন। ইন্টারনেট–সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ করে সরকার। সারা দেশে গুলিসহ সংঘাতে অন্তত ৫৬ জন নিহত।

২০ জুলাই
দেশজুড়ে কারফিউ জারির ফলে সেনা মোতায়েন হয়। ঘোষণা হয় সাধারণ ছুটি। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গুলি চলতে থাকে। সহিংসতায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে অন্তত ২৬ জন নিহত হন।

এদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকেও এদিন তুলে নিয়ে যায় নিরাপত্তা সংস্থা।

২১ জুলাই
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসে—কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ থাকবে।

২২ জুলাই
কোটাপ্রথা সংস্কার করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তৈরি করা প্রজ্ঞাপন অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা শেখ হাসিনা।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিগত সহিংসতায় চার দিনে অন্তত ১৩১ জনের নিহত হওয়ার খবর আসে সংবাদমাধ্যমে। আসে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের খবর।

২৩ জুলাই
কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। রাতে সীমিত আকারে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট–সেবা চালু হয়।

২৪ জুলাই
নির্বাহী আদেশে তিনদিন সাধারণ ছুটির পর অফিস খোলে। কারফিউ শিথিল হয়।

২৫ জুলাই
ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রো স্টেশন পরিদর্শন করেন। সেদিন ঢাকা শহরে ঘটে যাওয়ার নানা ঘটনায় দেশবাসীর কাছে কেঁদে কেঁদে বিচার চান তিনি।

২৬ জুলাই
এলাকা ভাগ করে সারা দেশে ‘ব্লক রেইড’ নামে অভিযান শুরু হয়। দেওয়া হয় অন্তত ৫৫৫টি মামলা। নাহিদ ইসলামসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি।

২৭ জুলাই
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

২৮ জুলাই
কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ডিবির হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেন। মোবাইল ইন্টারনেট ১০ দিন পর সচল হয়।

আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় ১৪৭ মৃত্যুর তথ্য দেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যদিও গণমাধ্যমের হিসাবে ওই সংখ্যা দুই শতাধিক দাঁড়ায়।

২৯ জুলাই
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয় ১৪ দলের বৈঠকে। ৬ সমন্বয়ক থাকেন ডিবি হেফাজতে। যাকে-তাকে ডিবি হেফাজতে নিয়ে ভাত খাইয়ে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না’।

৩০ জুলাই
তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার ৩০ জুলাই রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করলে তা প্রত্যাখ্যান করে হত্যার বিচার চেয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল করা হয়। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের প্রোফাইল লাল রঙের ফ্রেমে রাঙান অনেকে। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জাতিসংঘ মহাসচিব বিবৃতি দিয়ে স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানান।

৩১ জুলাই
‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা। কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে বিক্ষোভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদযাত্রা ঘিরে ধস্তাধস্তি হয়।

৩২ জুলাই (১ আগস্ট)
ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। বেলা দেড়টার একটু পরেই তারা ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের একটি গাড়িতে বেরিয়ে আসেন। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।

৩৩ জুলাই (২ আগস্ট)
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জুমার নামাজের পর দোয়া ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালিত হয়। ২৮ জেলায় এ কর্মসূচি পালিত হয়। শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি পালন। শিল্পীসমাজের ব্যতিক্রমী প্রতিবাদে শামিল হন সর্বস্তরের মানুষ।

৩৪ জুলাই (৩ আগস্ট)
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাদের জন্য গণভবনের দরজা খোলা। সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনকারীরা। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে উত্তাল হয় বাংলাদেশ। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন শিক্ষার্থীসহ হাজারো জনতা। সেখানে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন ঐতিহাসিক এক দফা- সরকারের পদত্যাগ।

৩৫ জুলাই (৪ আগস্ট)
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি পালন করে। এদিন ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। সারা দেশে ব্যাপক সংঘাতে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়।

৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট)
আগের দিন ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয় ৬ আগস্টের জন্য। কিন্তু ৪ আগস্ট দমন-পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ দেখে সেটি এগিয়ে নিয়ে আসা হয় ৫ আগস্ট। সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। পরিস্থিতি বেগতিক হয়ে পড়ে সরকারের জন্য। জনরোষে পড়ার ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। দুপুরে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। গণভবন, সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে অসংখ্য মানুষ। আর এভাবেই অবসান ঘটে দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনের।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ও পরিকল্পনার সরাসরি জড়িত ছিলেন সমন্বয়ক আব্দুল কাদের। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী অবস্থান থেকে আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের অবহেলা করে। ১৫ জুলাই সোমবার ছাত্রলীগ নারকীয় হামলা করে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। ১৬ তারিখ যখন আমরা খবর পেলাম সারাদেশে ছয় জন শহীদ হয়েছেন। মিটিং করে আমরা এজেন্ডা সেট করলাম, ছয়টি লাশ পড়ে যাওয়ার পর আন্দোলন কি কোটায় সীমাবদ্ধ থাকে? সবাই একমত হলো, এর পরিসর আর কোটায় নেই। আমরা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বললা, ‘সরকারই উদ্ভূত সমস্যার জন্য দায়ী এবং সরকারকেই সমাধান করতে হবে’।   

১৮ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যখন এক ধরনের হাল ছেড়ে দেয়, তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনকে চাঙ্গা রাখে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছিলেন। এটা অত্যন্ত সত্য যে, যাদের ‘পশ’, ‘দেশকে অউন করে না’ বলে কেউ কেউ, তারাই মাঠ চাঙা রেখেছিল সেসময়।

আন্দোলনের ৯ দফা ঘোষণার পর কোটা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। আব্দুল কাদেরই অ্যানালগ ফোন ব্যবহার করে নানা কৌশলে ৯ দফা গণমাধ্যমের কাছে পৌঁছে দেন। আলাদা আলাদাভাবে কখনো একটি একটি করে দফা পাঠিয়েছেন, কখনো ফোনেই সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে বলেছেন দফাগুলো।

৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে নাহিদ ইসলাম এক দফা ঘোষণা করলেও মাঠে আসার আগে এক দফা ঘোষণার বিষয়টি চূড়ান্ত ছিল না বলে জানান আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, মাঠ এক দফার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তত ছিল। সিনিয়ররা মাঠে এসে যখন পরিস্থিতি দেখলেন, তখন তারা এক দফা ঘোষণা করলেন। অবশ্য আমরা আগে থেকেই তাদের এক দফা ঘোষণার চাপ দিয়ে আসছিলাম। কারণ মানুষের জীবন নিয়ে আমরা নিরীক্ষা চালাতে পারি না।

৬ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৫ আগস্ট এগিয়ে আনার বিষয়ে তিনি বলেন, জ্যৈষ্ঠ সন্বয়করা বুঝে-শুনে এগোতে চাইছিলেন। কিন্তু মাঠের অবস্থা দেখে আমরা শেখ হাসিনাকে সময় দিতে রাজি ছিলাম না। লং মার্চ এগিয়ে আনতে আমি চাপ দিলাম। কারও কারও সঙ্গে বাকযুদ্ধও হলো। শেষে আসিফ ভাইয়েরা লংমার্চ এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিলেন। সে কারণে শেখ হাসিনা মাঠ পরিস্থিতি গুছিয়ে নেওয়ার সময় পাননি।

এফএইচ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।