ঢাকা: মেহের আফরোজ চুমকি। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী।
প্রতিমন্ত্রী চুমকি সম্প্রতি সচিবালয়ে তার দফতরে স্বপ্ন ও বাস্তবায়নের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন বাংলানিউজের সঙ্গে। সঙ্গে ছিলেন স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এস এম আব্বাস।
আলাপচারিতার শুরুতেই প্রতিমন্ত্রী তার শৈশবের সংগঠন মুকুল ফৌজ নিয়ে কথা বলেন। তিনি জানান, শিশুদের কল্যাণ করার মুকুল ফৌজের সেই প্রত্যয় বুকে ধারণ করে আজ হয়ে উঠেছেন প্রতিমন্ত্রী। এখন তিনি ভাবেন তৃণমূল পর্যায়ে যেভাবে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে, রাজনীতির উঁচু পর্যায়েও এই সংখ্যা প্রত্যাশিত হবে একদিন। প্রতিটি শিশুর বাসযোগ্য হবে বাংলাদেশ।
১৯৬৯ সালের আগে চুমকি যোগ দেন শিশু সংগঠন ‘মুকুল ফৌজে’। তারপর নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে কাজ করার পর রাজনীতি শুরু করেন। এরপর আর থামতে হয়নি তাকে। কম সময়েই নারী ও শিশুর উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখার সুযোগ পান সরকারের প্রতিমন্ত্রী হয়ে।
যখন সরকারের প্রতিমন্ত্রী কিংবা রাজনীতিক ছিলেন, সেই শৈশবের শিশু সংগঠন ‘মুকুল ফৌজ’ করার দুরন্ত সময়ের নানা কথা স্মরণ করেন। শিশু ও নারীদের কল্যাণে আত্মনিয়োগের অনুভূতি ফুঠে উঠে তার মুখে, একজন সাধারণ নারীর মতোই। তবে একান্ত আলাচারিতার মাঝেও তার নেতৃত্ব-গুণের পরিচয় মেলে। মন্ত্রণালয়ের কোনো দায়িত্ব থেকে কিছু যেন বাদ না পড়ে, সেজন্য তার কক্ষে কর্মকর্তাদের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করেননি। দুরন্ত কৈশোর ও কলেজ জীবনের গল্পের আলাপচারিতার মধ্যেও মন্ত্রণালয়ের কাজ বুঝিয়ে দেন কর্মকর্তাদের।
১৯৫৯ সালের ১ নভেম্বর জন্ম নেওয়া চুমকির শৈশব কাটে গাজীপুরের গ্রাম কালীগঞ্জ আর রাজধানী শহরের সিদ্ধেশ্বরীর আলো-ছায়ায়। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে পড়ার সময়কালেই তিনি যোগ দেন শিশু সংগঠন মুকুল ফৌজে। বদরুন্নেছা কলেজে পড়ার সময়ও শিশু সংগঠন ও স্বেচ্ছাসবী সংগঠনে কাজ করেন তিনি। এ সময় বাবার রাজনৈতিক জীবনেরও প্রভাব পড়ে চুমকির জীবনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবা শহীদ ময়েজউদ্দিরের রাজনৈতিক জীবন ও আদর্শ কাছ থেকেই দেখার সুযোগ হয় তার।
শহীদ ময়েজউদ্দিন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজ সেবক। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শহীদ ময়েজউদ্দিন রেড ক্রিসেন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান, ফ্যামিলি প্লানিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু ও অন্য আসামিদের পক্ষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৮৪ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হন।
চুমকি ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে অনার্সসহ মাস্টার্স পাস করেন। পরবর্তী সময়ে রাজনীতি ও বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৯৫ সালে রমনা থানার ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে সংরক্ষিত মহিলা আসন গাজীপুর-৫ (কালীগঞ্জ) থেকে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। বর্তমানে কমনওয়েলথ উইমেন অ্যাফেয়ার্স মিনিস্টারদের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন চুমকি। এছাড়া, নারী ও শিশু উন্নয়নে জাতীয় কমিটির সদস্য, অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ারম্যান (ওয়াটার, সেনিটেশন ও হাইজিন) এবং জাতীয় এইডস কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
এর আগে, চুমকি নবম পার্লামেন্টের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার আগেই ফ্যামিলি প্লানিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফপিএবি) সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মন্ত্রী হওয়ার পর শিশু ও নারী উন্নয়নে সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয় তার।
প্রতিমন্ত্রী চুমকি বলেন, দেশের ৪৪ শতাংশ শিশুর মধ্যে প্রায় অর্ধেক কন্যাশিশু। যাদের প্রত্যেকের শিক্ষা নিশ্চিত করার জরুরি। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর নারী ও শিশুদের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন কাজ করছি। দেশের দুর্গম এলাকায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্যে ২ হাজার ১০৯টি শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করতে পেরেছি।
তিনি জানান, বর্তমান সময়ে শিশু নির্যাতনের ঘটনার পর সহিংসতা রোধে মনিটরিং এবং সচেতনতামূলক প্রথম কাজ বাংলাদেশে শুরু করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
চুমকি বলেন, আমি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছি। এটি আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। এই দায়িত্বটাকে সফলভাবে পালন করতে হবে আমাকে। আমি আমার অবস্থান নিয়ে চিন্তা করি না। আমার কাজের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করি। আমার কাজের ব্যাপারে আমি শতভাগ সন্তুষ্ট নয়। অনেক কাজই বাকি আছে। যখন দেখবো বাংলাদেশের নারীদের মুখে হাসি, তখনই আমার সার্থকতা। এর বাইরে আমি নিজেকে সার্থক হিসেবে দেখি না।
নারী ও শিশু উন্নয়ন ভাবনা তাড়িত করে তাকে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখনও পত্র-পত্রিকা খুললেই অনেক মা-বোনের নির্যাতনের খবর পাই। শিশুদের ওপর সহিংসতার খবর পাই। সেগুলো শতভাগ নির্মূল করা হয়তো আমাদের মতো দেশে সম্ভব নয়, উন্নত দেশেও সম্ভব হয়নি। তবে এই জায়গাটি অনেক ভাল পর্যায়ে যেতে চাই।
চুমকি মনে করেন, রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ে নারীর সংখ্যা এখনও হাতেগোনা। সেই সংখ্যাটা বৃদ্ধি হওয়া উচিত। রাজনীতির অঙ্গনটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গন নারীদের জন্য। যেখান থেকে নারী শুধু তার নিজের অধিকার আদায় করবে না, সমষ্টিগত, গোষ্ঠীগত, অধিকারের জন্য কথা বলতে পারে। পলিসি তৈরি করতে পারে এবং তা বাস্তবায়ন করতে পারে। তখনই তা সম্ভব, যখন রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ে নারীরা তাদের অবস্থান তৈরি করতে পারে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ সংখ্যা এখনও প্রত্যাশিত না হলেও আশা করছি, যেভাবে তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে সেই সংখ্যাটা একদিন উপরের দিকে পৌঁছাবে, তখনই নারীর পুরোপুরি ক্ষমতায়ন হবে। প্রতিটি শিশুর বাসযোগ্য হবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৫
এসএমএ/এইচএ