ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কল্যাণপুরের পোড়াবস্তি উচ্ছেদ

‘গরিবের পেটে লাথি দিছে, আল্লাহ সইবো না’ (ভিডিওসহ)

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৬
‘গরিবের পেটে লাথি দিছে, আল্লাহ সইবো না’ (ভিডিওসহ) ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কল্যাণপুর পোড়াবস্তি থেকে: ‘ঘর ছাড়া করছে, গরিবের পেটে লাথি দিছে, আল্লাহ সইবো না। হাতে নাই ট্যাকা-পয়সা, এহন কই যামু, কী করমু?’
 
আহাজারি তুলে কথাগুলো বলছিলেন কল্যাণপুরের চার নম্বর পোড়াবস্তির বাসিন্দা আকলিমা বেগম (৪২)।

তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে এই বস্তিতে বসবাস করতেন।

স্থানীয় সংসদ সদস্যের একটি পোস্টার হাতে তুলে কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বলেন, যার এতো যত্ন করছি, সেই আমগো পেটে লাথি মারছে। এই পোস্টার ঘরের মধ্যে ঝুলাইয়া রাখছিলাম। কিন্তু আজ যত্নের বদলে ঘর ভাইঙ্গা দিলো।
 
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এই বস্তিতে বসবাস করেন তসলিম আহম্মদ। ভোলার ইলিশায় তার বসতভিটা ছিলো। মেঘনার জোয়ারে ভিটা হারিয়েছেন তিনি। নিঃস্ব হয়ে জীবিকার তাগিদে আসেন ঢাকায়। শুরু করেন রাজ-জোগালের কাজ।
 
কম খরচে একটু মাথা গুঁজে থাকতেই আসেন কল্যাণপুরের পোড়াবস্তিতে। ঘাম ঝরানো পারিশ্রমিক দিয়ে একটি ঘর তুলে বসবাস করছিলেন তসলিম। উচ্ছেদের কারণে তার কষ্টে গড়া ঘরটিও ভাঙা পড়েছে। সব হারিয়ে তিনি এখন আবারও নিঃস্ব।
 
ক্ষোভ আর দুঃখ নিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, নদী নিলো বসত-ভিটা আর মানুষ করলো ঘরছাড়া। জীবনে দুঃখই পাইলাম, শান্তি আর পাইলাম না।
 
‘শীতে ঘরের ভেতর থাকতেই কষ্ট হয় আর ছোট একটা বাচ্চা নিয়া দুইদিন ধরে রাস্তায় কাটাইলাম। হাতে ট্যাকা নাই, খাওন (খাবার) পাই না, কী করমু, আমরা যামু কই?’
 
শুধু আকলিমা বা তসলিমই নয়, শত শত মানুষের আহাজারি এখন কল্যাণপুরের পোড়াবস্তিতে। তাদের বেশিরভাগই নদী ভাঙনে সব হারিয়ে এ বস্তিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়েছিলেন। এখন তাও নেই।
 
বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) রাজধানীর কল্যাণপুরে দক্ষিণ পাইকপাড়ায় হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বেদখল জমি উদ্ধারে নতুন বাজারসহ পোড়াবস্তি উচ্ছেদ অভিযান চালায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদফতর। এসময় বস্তিবাসীর সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় পুলিশের। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। ওই দিন দুপুরে বস্তি উচ্ছেদ বন্ধে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিলেও বিকেল পর্যন্ত চলে গণপূর্ত বিভাগের উচ্ছেদ অভিযান। এ উচ্ছেদ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন গণপূর্ত বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেট নূর আলম।

তিনি ওইদিন বলেন, আমরা এখনও অফিসিয়ালি কোনো অর্ডার পাইনি।
 
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক আবেদনের শুনানি নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দেন বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাইকোর্ট বেঞ্চ।
 
পাশাপাশি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া ওই বস্তি উচ্ছেদ ও বস্তির বাসিন্দাদের হয়রানি না করতেও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
 
এদিকে, সোমবার (২৫ জানুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, আগে থেকেই কল্যাণপুরের ওই পোড়াবস্তিতে হাইকোর্টের বিজ্ঞপ্তি সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড রয়েছে। কালো রঙের একটি বোর্ডে সাদা কালিতে লেখা রয়েছে, ২০০৩ সালে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কল্যাণপুরের ওই জমি থেকে বস্তি উচ্ছেদ ওই বছর ২৪ ডিসেম্বর আদালত স্থিতাবস্থার নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করা হয়।

এদিকে, ২০০৬ সালে মন্ত্রণালয় আবারও উচ্ছেদ চালানোর জন্য চিঠি দিলে আসক ফের আদালত যায়। ওই বছর ২৫ জুন আদালত উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশ দেন। বিভিন্ন সময়ে এই মেয়াদ বাড়ানোর পর ২০০৭ সালের ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ান।

বস্তিবাসীর অভিযোগ, আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেও বস্তিতে উচ্ছেদ অভিযান চালায় গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
 
বস্তিবাসির অভিযোগ, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার কাগজপত্র নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. আসলামুল হকের কাছে গেলেও তা তিনি আমলে নেননি। বরং ওই কাগজপত্র সবার সামনে ছুড়ে ফেলে দেন।  
 
বস্তির বাসিন্দা আব্দুল জালিল বাংলানিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে এই বস্তির আড়াই থেকে তিনশো লোক বস্তি উচ্ছেদে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছে যান। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শোনেননি।
 
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য আমাদের জনপ্রতিনিধি। কিন্তু তিনিও আমাদের দুঃখের সময় মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
 
এ বস্তিতে অন্তত পাঁচ থেকে সাত হাজার ভোটার রয়েছেন বলে জানান তিনি।
 
এদিকে, উচ্ছেদের পরদিন শুক্রবার (২২ জানুয়ারি) পোড়াবস্তির আট নম্বর অংশে সকাল ১০টার দিকে রহস্যজনকভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বেলা ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের দুই ইউনিট প্রায় দুই ঘণ্টা চেষ্টার পর তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে এ ঘটনায় বস্তির ৬০ থেকে ৭০টি ঘর পুড়ে গেছে বলেও দাবি করেন বস্তিবাসীরা।
 
বস্তিবাসীর অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে এই আগুন লাগায় স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ‘লাল বাহিনী’র সদস্যরা। ওই নেতার আট থেকে ১০ জন কর্মী মাথায় লাল ফিতা বেঁধে এ অগ্নিকাণ্ড ঘটান।
 
মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) শফিকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কল্যাণপুরের পোড়াবস্তিবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থে সেখানে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়ন রয়েছে।
 
বস্তিবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার কোনো ক্ল্যু পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না সেখানে তেমনকিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি।
 
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঘরহারা অনেকেই তাদের জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তায় বসে রয়েছেন। অনেকেই চলে যাচ্ছেন অন্যত্র।  
 
এসময় বস্তির এক বাসিন্দা আল-আমিন বলেন, চার বছর আগে এই বস্তিতে এসেছিলাম। দুই হাজার টাকায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে থেকেছি। এখানে থাকার জায়গা নেই। কল্যাণপুরের বৌ-বাজারের একটি বাড়িতে এক রুম ভাড়া নিয়েছি। ছোট দুই ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে এখন সেখানে যাচ্ছি।
 






বাংলাদেশ সময়: ০১১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৬
এসজেএ/এসএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।