এর আগে ২০০৭ সালে একবার দখলমুক্ত করাও হয়েছিল কিন্তু তারপর ছয়মাসের মধ্যেই পুরো খাল ফের দখল হয়ে গেছে। সুতরাং এসব ঘোষণায় তাদের ভরসা নেই।
অপরজন পাশে থেকে বললেন, শুনেছি এবার মেয়র যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। হতে পারে এবার পুরনো খাল ফিরে পাওয়া যাবে।
এদের আরেক বন্ধু বললেন, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একবার স্থাপনা ভাঙ্গা হয়েছিলো। তখন এখানে একটি স্কুল ছিল। সেটিও ভেঙ্গে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরে সে এলাকা ঠিকই নতুন করে দখল হয়ে গেছে। স্কুল গেছে কিন্তু এখন তা দখলে গেছে প্রভাবশালীদের। তারা দোকান বানিয়ে ভাড়া দিচ্ছে। যেনো জোর যার মুল্লুক তার।
রাজধানীর মান্ডার খালের নন্দীপাড়া থেকে ত্রিমোহনী পর্যন্ত দখলমুক্ত করতে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের দেওয়া ঘোষণা নিয়ে কথা হচ্ছিল খালের ওপর করা একটি ব্রিজে দাঁড়িয়ে।
‘কারা দখল করেছে এই খাল?’--এ-প্রশ্নের উত্তরে একজন বললেন, এইখানে কুতুবের অভাব নাই। আর একজন একটু দখল করলে আরেকজন আরেকটু করে।
এক বন্ধু বললেন, একটু সামনে গেলে একটা মসজিদ পাবেন বলতে গেলে খালের ওপর। এই এলাকায় মসজিদের অভাব নাই। এই একটা ইউনিয়নে তেত্রিশটা মসজিদ। খাল দখল করে একটা মসজিদ বানানোর কি দরকার? তাও বানিয়েছে। এই ব্যাপারগুলো আসলে দেখার কেউ নাই।
পাশ থেকে অপর বন্ধুর কথা, মেয়র কি আইছে কোনও দিন! মেয়র তো কতকিছুই বলে। সাংবাদিকরাও পত্রিকায় লেখে। আইজকা পত্রিকায় দেখলাম অবৈধ স্থাপনা ভাঙ্গা হবে। এই মাথা থেকে ওই মাথায় সবই তো অবৈধ স্থাপনা। কয়টা ভাঙবো!
অদূরে জেলা পরিষদ মার্কেট দেখিয়ে তিনি বলেন, এটাও অর্ধেকটাই খালের ভেতর। এটিওতো জেলাপরিষদেরই ভবন। এটাও সরকারের। খালও সরকারের। কে কাকে বাধা দেবে?-- প্রশ্ন তার।
১৯৯০ সালে ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে এরশাদ সরকার খালের ওপর দিয়ে এই মার্কেট তৈরি করে। জেলাপরিষদ মার্কেট নাম দিয়ে চলছে। নিচের পানিতে বড় বড় পিলার দিয়ে মার্কেট ভবনটি তৈরি। মার্কেটের নিচের একটি পিলার দেখিয়ে তিনি বলেন, ওই পিলার পর্যন্ত খালের অবস্থান ওয়াসা চিহ্নিত করে গেছে। তাতে এই মার্কেটের আট থেকে দশ ফুটই খালের মধ্যে।
জেলা পরিষদ মার্কেটে যারা দোকান করছেন তাদেরও একই প্রশ্ন: ‘ভবনটিও কি ভাঙ্গা হবে’? তবে নিজেরাই আবার জবাব দিচ্ছেন, ২০০৭ সালে যখন ভাঙ্গা হয়নি তাহলে এবারও হবে না।
পাশে থেকে আরেকজন বলে উঠলেন, ভেঙ্গে ফেলাই ভালো। ভবনটি এখন পুরোই ঝুঁকিপূর্ণ।
ভবনের পেছনে খালের দিকের অংশে দেখা গেলো এটি খালের ভেতর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর বিভিন্ন পয়েন্টে রড বের হয়ে আছে। বোঝা গেলো যখন নির্মাণ করা হয়েছে, তখনই মাথায় ছিলো এই ভবন ক্রমশ খালের দিকে আরও বাড়ানো হবে।
তবে আড্ডারত তিন বন্ধুই একটি বিষয়ে একমত মেয়রের উদ্দেশ্য যদি সৎ থাকে তাহলে তিনি এই খাল দখলমুক্ত করতে পারবেন। ।
একজন বললেন, তাহলে আল্লাহও ওনার সাথে থাকবে। আর আমরাও তার সাথে আছি। এলাকাবাসীও আছে।
যারা বিভিন্ন স্থানে খাল দখল করে নিজেদের দোকানপাট-বসতবাড়ি তৈরি করেছেন তাদেরও মধ্যে খাল ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছাটাই দেখা গেলো।
গোলারবাড়ি এলাকার ঝর্ণা বেগমের ঘর খালের ভেতরে। থাকেন ছয় বছর ধরে। তবে উচ্ছেদ হলে তার আপত্তি নেই। বললেন, এইটাতো আর বাপের জমি না। সরকারের জমি। সরকার চাইলে ছাইড়া দিমু। করার কিছু নাই। বাপের জমি হইলে যুদ্ধ কইরা থাকতাম।
অপর একটি বাড়ি উঠেছে মোটে চারমাস আগে। এটি তুলেছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেখানে কথা হচ্ছিলো তার দুই পুত্রবধূর সঙ্গে। তারা বলছিলেন, সবাই দখল করেছে দেখে আমাদের শ্বশুরও একটি ঘর তুলেছেন। ছেড়ে দিতে হলে তিনিও ছেড়ে দেবেন। তবে কয়েকটা বছর থাকতে পারলে ভালো হতো। প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ করে ঘরটি তুলেছেন। তবে মনে দোলাচল এই দুই নারীর।
সত্যিই কি ছেড়ে দিতে হবে? পত্রিকায় তো কত কিছুই লেখে! পরে আর হয় না! এই বলে এখনই শেষ আশাটুকু ছাড়ছেন না তারা।
খালের ওপর বাঁশের শক্ত মাচা বসিযে হোটেল খুলে গত চার-পাঁচ মাস ভালোই ব্যবসা জমিয়েছেন আলী হোসেন মোল্লা। তারও একই প্রশ্ন: ‘সত্যিই কি ছেড়ে দিতে হবে?’
গত ২২ জানুয়ারি (রোববার) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাইদ খোকন রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল, বক্স কালভার্ট ও রাস্তা অবৈধ দখলমুক্ত করার জন্য ঘোষণা দেন। প্রাথমিকভাবে আগামী ৬ এবং ৯ ফেব্রুয়ারি নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খাল ও হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকার রাস্তা অবৈধ দখলমুক্ত করার জন্য অভিযান চালানো হবে বলে জানান তিনি।
ঢাকা শহরের খাল ও বক্স কালভার্টগুলো অবৈধভাবে দখল করে ভরাট করায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে প্রতি বছর। তাই মেয়রের ঘোষণাকে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন সাহসী। কেউ বলছেন অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।
** সবাই চান খালটি ফিরে আসুক
বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৭
এমএমকে/জেএম