ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ভয়াল ১২ নভেম্বর: আজও কাঁদেন স্বজনহারা মানুষ

ছোটন সাহা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৮
ভয়াল ১২ নভেম্বর: আজও কাঁদেন স্বজনহারা মানুষ ফাইল ফটো

ভোলা: ভয়াল ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এইদিনে ভোলার উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। এতে প্রাণ হারায় এক লাখের বেশি মানুষ। সেই ঝড়ের কথা মনে করে আজো আতঁকে উঠেন সমগ্র উপকুলের মানুষ। স্বজনহারা মানুষ এখনও ভুলতে পারেনি সেই দুর্বিসহ স্মৃতি।

৭০ এর ভয়াল সেই ঝড়ে পুরো জেলা লণ্ড ভণ্ড হয়ে যায়। সেসময় নদীতে যেমন ভাসছিলো লাশ ঠিক তেমন গাছে গাছেও ঝুলেছিলো লাশ।

 

ঝড়ে দ্বীপজেলা ভোলার সাত উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। সেদিন মারা যায় এক লাখের বেশি মানুষ। ঝড়ের ক্ষতচিহ্নের বর্ণনা করতে গিয়ে আজো শিউরে উঠেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

স্বজনহারা আলীনগর এলাকার মো. মনির বলেন, ঝড়ে আমার তিন বোনকে হারিয়েছে। তাদের কথা মনে করে আজো আমরা কাঁদি।

প্রত্যক্ষদর্শী তুলাতলী এলাকার বাদশা মিয়া বলেন, মেঘনা নদীতে মানুষের মরদেহ ভাসতে দেখেছি। পরিচিতদের উদ্ধার করেছি। বাকি মরদেহ স্রোতে ভেসে গেছে।

স্থানীয় রহমত আলী, ছিদ্দিক ও সিরাজ উদ্দিন বলেন, সেদিনের ঝড়ে মদনপুরের ১৮টি ঘরের মধ্যে ৪০ জনের মরদেহ পাওয়া যায়। একটি পরিবারে সবাই মারা গিয়েছিল।

প্রত্যক্ষদর্শী শাহে আলম বলেন, সেদিন দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল। রাতে পুরো দমে ঝড় শুরু হয়। ভোরে জলোচ্ছ্বাসে মানুষ মারা যায়, ভেসে যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন উপজেলায়।  

প্রবীণ সংবাদিক ও দৈনিক বাংলার কণ্ঠ সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান বলেন, বন্যার পরে দেখেছি দৌলতখানের চৌকিঘাটে সাপ আর মানুষ একসঙ্গে জড়িয়ে পড়ে আছে। স্নেহময়ী মা তার শিশুকে কোলে জড়িয়ে পড়ে আছে মেঘনার পাড়ে। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে এক নারীর লাশ ঝুলছে। এমনিভাবে মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সমগ্র জেলায় মানুষ আর গবাদি পশু সেদিন বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলে ভেসে গেছে। জন-মানুষ শূন্য হয়ে পড়েছিলো দ্বীপজেলা ভোলা।
 
প্রবীণ সংবাদিক এম এ তাহের বলেন, ভয়াল সে রাত কেটে গেলে পরদিন শুক্রবার শহরময় ধ্বংস স্তুপ দেখা যায়। প্রায় এক কোমর পানি ছিলো সর্বত্র। চারিধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল শুধু লাশ আর লাশ। বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মরহুম মোশারেফ হোসেন শাহাজানসহ আরো অনেকে বেরিয়ে পড়েন ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায়। সেদিন সবাই মিলে প্রায় সাড়ে ৩শ’ লাশ দাফন করা হয়।

ভয়ানক সেই ঝড়ের কথা এখনো ভোলেনি উপকূলের মানুষ। ঝড়ের কয়েকদিন পর সামান্য কিছু সাহায্য মিলেছে তাদের। গাছে ঝুলে ছিল অনেকের মরদেহ। বাঁচার লড়াই করেছেন অনেকে। কেউ বেঁচেছেন তবে বেশিরভাগই তাদের স্বজনদের হারিয়েছেন।  

এদিকে উপকূলবাসীদের অভিযোগ, উপকূলে একের পর এক দুর্যোগ আঘাত হানলেও আজো উপকূলবাসীর জন্য টেকসই বেড়িবাঁধ কিংবা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ হয়নি। প্রতিবছরই ঝড় আসে। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু এখনো এখানকার মানুষ মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করে। ঝড় কিংবা ঘূর্ণিঝড় এলেই মৃত্যু তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।

১৯৭০ সালের এই দিনে উপকূলবাসীর জীবনে নেমে আসে এক মহাদুর্যোগ। মহাপ্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নিমিষে উপকূলীয় চরাঞ্চল ১০ থেকে ১২ ফুট পানিতে বাড়িঘর, সোনালি ফসলের মাঠ, উঠানে স্তূপাকার ও গোলা ভরা পাকা ধান তলিয়ে যায়। স্রোতের তোড়ে ভেসে যায় হাজার হাজার মানুষ ও কয়েক লাখ গরু-মহিষ। বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয় উপকূলীয় এলাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাপক ফসলি জমি, প্রাণী ও বনজসম্পদ।

বাংলাদেশ সময়: ০১০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৮ 
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।