সম্প্রতি পোনা সংকটে গলদা চাষিদের মাথায় হাত উঠেছে। বাগেরহাট জেলার গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলো বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রাকৃতিক উৎসের রোগাক্রান্ত পোনা ও পার্শবর্তী দেশ ভারত থেকে আসা কিছু পোনার ওপর ভরসা করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা। ভারতীয় এসব পোনার উৎপাদন ও টিকে থাকা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষকরা।
এদিকে প্রকৃতিতে এ্যামোনিয়া গ্যাস ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় গলদা পোনা উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় লোকসানে পড়ে হ্যাচারি বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকরা। কোনো কোনো গলদার হ্যাচারিতে বিকল্প হিসেবে কার্প জাতীয় মাছের চাষ শুরু হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন গলদা চিংড়ি চাষিরা।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট উৎপাদিত চিংড়ির এক তৃতীয়াংশ গলদা চিংড়ি উৎপাদন হয় বাগেরহাটে। এ জেলায় ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে ৪৯ হাজার গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। এতে ৪০ হাজার চাষি গলদা চাষ করে। এসব ঘেরে প্রতি বছর প্রায় ২১ কোটি পোনার চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বাগেরহাট জেলার কোনো হ্যাচারিতে বর্তমানে একটি পোনাও উৎপাদন হচ্ছে না। জেলায় মৎস্য অধিদপ্তরের লাইসেন্সকৃত গলদা পোনা উপাদনকারী ৭টি হ্যাচারি এবং লাইসেন্স ছাড়াও বেশ কয়েকটি হ্যাচারি ছিল। যা দিয়ে মোট চাহিদার একটা বড় অংশ পূরণ হতো। কিন্তু সর্বশেষ ২০১৮ সালে হ্যাচারিগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
লাইসেন্সকৃত হ্যাচারিগুলোর মধ্যে সদর উপজেলার শ্রীঘাট এলাকায় ব্র্যাক গলদা চিংড়ি হ্যাচারি-১ ও ২, বাগেরহাট হ্যাচারি, আশা মৎস্য হ্যাচারি, একই উপজেলার পশ্চিমভাগে খানজাহান আলী হ্যাচারি ও নার্সারি, চিতলমারিতে মনোয়ার কবির হ্যাচারি এবং মোরেলগঞ্জ উপজেলায় রুপা এ্যাগ্রো ফিশারিজ।
মৎস্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়াও বাগেরহাট সদরের হাইটেক গলদা চিংড়ি হ্যাচারি, কচুয়ার রেইনবো গলদা চিংড়িসহ কয়েকটি হ্যাচারি দুই এক বছর উৎপাদন করে বন্ধ হয়ে গেছে।
ব্র্যাক গলদা চিংড়ি হ্যাচারির ব্যবস্থাপক হোসনে আজম বলেন, ‘২০০১ সালে উৎপাদনে যাওয়ার পর থেকে ১৫ সাল পর্যন্ত ভালভাবেই চলছিল। ২০১৬ সাল থেকে উৎপাদন না হওয়ায় লোকসান হয় আমাদের। পরে আমাদের দু’টি হ্যাচারিই বন্ধ করে দেই। এখন একটিতে মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ হচ্ছে। অন্যটি একদম বন্ধ রয়েছে।
‘বাগেরহাট হ্যাচারির’ মালিক বিমল কুমার মিত্র বলেন, ২০০৫ সালে হ্যাচারি স্থাপন করে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক মৌসুমে আমরা ৭০ থেকে ৮০ লাখ পোনা উৎপাদন করেছি। কিন্তু ২০১৩ সালে আমাদের উৎপাদনে ধস নেমে লোকসানে পড়ে প্রতিষ্ঠান। ২০১৪, ১৫, ১৬ এবং ১৭ সাল পর্যন্ত পোনা উৎপাদনের জন্য চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো উৎপাদন হয় নাই আমাদের। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালে আর ব্যর্থ চেষ্টা করিনি। ৫ বছরে আমরা প্রায় ১ কোটি টাকা ঋণে পড়েছি।
চিংড়ি পোনা কারবারি মজিদ শেখ বলেন, একসময় আমরা হ্যাচারি ও নদী দুই ধরনের পোনা বিক্রি করতাম। কিন্তু জেলার হ্যাচারিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের নদীর পোনার ওপর নির্ভর করতে হয়। চাষিদের পোনার চাহিদা মেটাতে আমাদের হিমসিম খেতে হচ্ছে।
চিংড়ি চাষি সরদার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গলদা চাষে আমাদের নানারকম সমস্যার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। সময় মত ভাল পোনা সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রাকৃতিক উৎসের প্রতি নির্ভর হওয়ায় সময় মত পোনা পাই না। যতদিন পর্যন্ত হ্যাচারিতে ভাল পোনা উৎপাদন না হয় ততদিন পর্যন্ত প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা আহরণের দাবি জানান তিনি।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী জানান, গত দুই বছর ধরে উৎপাদন ভাল না হওয়ায় জেলার হ্যাচারিগুলো একবারে বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ এ্যামোনিয়া গ্যাস বৃদ্ধির কারণে হ্যাচারিতে উৎপাদিত লার্ভা (পোনা) মরে যাচ্ছে। যেসব হ্যাচারিতে ভাল পোনা উৎপাদন হয় চাষিদের সেখান থেকে পোনা সংগ্রহের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে মৎস্য অধিদপ্তরের নিজস্ব হ্যাচারিতে ভাল পোনা উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হ্যাচারিগুলো কেন গলদার পোনা উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে সেটি খুঁজতে আমরা কয়েক বছর ধরে গবেষণা করছি। এক বছর একটি সমস্যা ধরা পড়লে অন্য বছর নতুন আরেকটি সমস্য ধরা পড়ে। সম্প্রতি পানিতে এ্যামোনিয়া গ্যাসের বৃদ্ধির কারণে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। হ্যাচারির সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। মূল সমস্যা চিহ্নিত করতে পারলে হ্যাচারিগুলো আবারও পোনা উৎপাদন করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৯
আরএ