সারা দেশে যখন বিজয় মিছিল, র্যালি ও সমাবেশের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের প্রথম বর্ষপূর্তি উদযাপিত হলো, তখন জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ নেতাদের পাঁচজন কক্সবাজারের ‘ঘুরতে’ যান।
যাদের নেতৃত্বে, আন্দোলনে ও সংগ্রামে শেখ হাসিনার পলায়ন, সেই নেতাদের এমন আচরণ ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
সারজিস আলম তার এক ফেসবুক কমেন্টে লেখেন, মিডিয়া প্রোপাগান্ডারও একটা লিমিট থাকে...! ন্যূনতম পেশাদারত্ব তো থাকা উচিত।
গুম,খুন, ভোটাধিকার হরণ,বৈষম্য, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত খেকে দেশবাসীকে রেহাই দিতে গত বছরের ৩৬ দিন ধরে ছাত্রদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে গণঅভ্যূত্থানে ১৬ বছরের প্রধানমন্ত্রীর পতন হয়। এটিই বাংলাদেশের প্রথম কোনো সরকারপ্রধানের পালাতে বাধ্য হওয়ার ঘটনা।
বুলেটের মুখে বুক পেতে দেওয়া সেই ছাত্র সমন্বয়করা পরে গড়ে তোলেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সেই নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা ও যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট তথা জুলাই গণঅভ্যূত্থান দিবসে কক্সবাজারে ঘুরতে যান।
যেদিন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রসহ সারা জাতি দিবসটি পালন করছে তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়, এনসিপির নেতারা কক্সবাজারে পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
এ নিয়ে খবর প্রচারের পর নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, কক্সবাজার বিএনপির সভাপতি, পুলিশ সুপার গণমাধ্যমে কথা বলেন। এক পর্যায়ে তাদের অবস্থান করা হোটেলের সামনে বিক্ষোভ করেন স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধমেও।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিবিসিকে বলেন, হুট করে ঘুরতে আসছিলাম, পদযাত্রাতে টায়ার্ড হয়ে গেছিলাম। জাস্ট এমনে একটু সাগর পাড়ে ঘুরতে আসছিলাম। হোটেলে চেক ইন করে মাত্র বসছি, এর মধ্যেই এই নিউজ দেখলাম। এটা টোটালি একটা গুজব, মিস ইনফরমেশন, এ ধরনের কোনো কিছুই না, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা।
কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী গণমাধ্যমে বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বর্ষপূর্তির বিশেষ দিনে হঠাৎ করে এনসিপির শীর্ষ পাঁচ নেতার কক্সবাজার আগমন এবং শহর থেকে ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের পাঁচ তারকা হোটেলে অবস্থানের ঘটনা সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। মানুষের মধ্যে নানা কৌতূহলের জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে তাদের সঙ্গে পিটার হাসের বৈঠকের কথা শুনে লোকজনের মধ্যে সন্দেহ আরও বাড়ছে। তবে পিটার হাসের উপস্থিতির বিষয় নিয়ে তিনি সন্দিহান। এ বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নিচ্ছেন।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. সাইফউদ্দীন বলেন, পাঁচ এনসিপি নেতা হোটেলে আছেন। তারা পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করছেন, এটা ঠিক নয়।
এদিন বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে এনসিপি নেতারা কক্সবাজারে পৌঁছান। এরপর তারা গাড়িতে করে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে কক্সবাজারের ইনানীর সিপার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা হোটেলে যান।
যখন পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে, তখন বিএনপির নেতা-কর্মীরা হোটেলের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে তারা বলেন, গতকাল একজন উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশে নাকি ওয়ান ইলেভেন সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমরা যারা ১৬ বছর রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে পতন করেছি, তারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র বরদাশত করব না। যেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হবে, আমরা সেখানে সমবেত হব। বাংলাদেশের ভাগ্য বাংলাদেশের মানুষই নির্ধারণ করবে। বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসা একজন বলেন, এমন দিনে তারা কেন কক্সবাজারে? যেখানে এখনো হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে প্রক্লেমেশনের অপেক্ষায়, জাতির ভবিষ্যতের ঘোষণার অপেক্ষায়, তারা কেন সেখানে যাবে?
তিনি বলেন, ঘটনা যতটুকু রটে তার কিছু অংশ হলেও ঘটে। ...আমরা ধরে নেব, হাসিনা যেমন তার বাপের কান্না দেখিয়ে এ দেশের মানুষকে বোকা বানাতো, তেমনি এই হাসনাত, সারজিসরা এই জুলাই ঘোষণাকে বিক্রি করে খাওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত আছে। যদি তা না হতো, তাহলে এমন দিনে সকাল থেকে তাদের উপস্থিতি দেখতে পারতাম। এর জন্য লজ্জা এবং ঘৃণা প্রকাশ করছি।
আরেকজন বলেন, আমরা জুলাই আন্দোলন করেছি একইসঙ্গে। ৫ আগস্ট কক্সবাজারে তাদের ঘুরতে যাওয়া এটা নিশ্চয়ই সন্দেহজনক। আমার মাথায় আসে না, আজকে ৫ আগস্ট এত বড় প্রোগ্রাম হচ্ছে কেন তারা এখানে নেই? কেন তারা কক্সবাজারে গেল এটা তারা জাতির কাছে খোলাসা করতে হবে। কারণ জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই নতুন দল গড়ে ওঠেছে। এর পেছনে কোনো দুরভিসন্ধি আছে কি না, এই প্রশ্ন করছি। সেটা উন্মোচন করতে হবে।
পিটার হাস ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ১৭তম রাষ্ট্রদূত ছিলেন। পিটার হাস বর্তমানে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানিতে যুক্ত মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির কৌশলগত উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত।
ইএস/এনডি