কয়রা (খুলনা): আমাগের দুঃখ-দুর্দশা দেখার কেউ নেই বাবু। এভাবেই বলছিলেন কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের গোলখালী গ্রামের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ অভিজিৎ মন্ডল।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জনপদ কয়রা উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ২৪ দশমিক ১৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সুন্দরবন ঘেঁষা সর্বশেষ জনপদ উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি। ইউনিয়নটি তিন পাশে নদী দ্বারা বেষ্টিত। দক্ষিণ ও পূর্বে সুন্দরবন এবং শাকবাড়িয়া নদী, পশ্চিমে কপোতাক্ষ নদী ও উত্তরে কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়ন। ইউনিয়নটির ১২টি গ্রামের যাতায়াতের প্রায় সব রাস্তা কাঁচা এবং ইট বিছানো। যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বৃষ্টি হলে চলে না কোনো যানবাহন। হেঁটে যেতে হয় গন্তব্যে।
জানা গেছে, জনপদ দক্ষিণ বেদকাশিতে ২৮ হাজার ৭০০ মানুষের বসবাস। ২০০৯ সালে আইলা থেকে শুরু করে রিমেলও এখানে আঘাত হানে, বেঁড়িবাধ ভেঙে প্লাবিত হয়। এখানকার বাসিন্দাদের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। নেই জীবনমানে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া। সারা বছরই দুর্যোগ আর বৃষ্টিতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় এই দুর্গম ইউনিয়নটির বাসিন্দাদের। প্রাচীন এ ইউনিয়নে কোথাও নেই পাকা (পিচ ঢালাই) সড়ক। দু’একটি ইটের সড়ক থাকলেও সেগুলোর ইট উঠে খানাখন্দে পরিণত হয়েছে। ইউনিয়নের গ্রামগুলোর অধিকাংশ বাড়িঘর এখনও কাঁচা (মাটির ঘর)। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এখনও অত্যন্ত নাজুক। এখানকার মানুষের একমাত্র জীবিকা সুন্দরবনে মাছ , মধু ও কাঁকড়া আহরণ। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকার কারণে জেলে মৌয়ালিরা তাদের মাছ, মধু ও কাঁকড়ার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের আহরণ করা মাছ, মধু কাঁকড়া উপজেলা সদর থেকে ট্রাকযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। তবে পরিবহন খরচ বেশি হওয়ার কারণে জেলে ও মৌয়ালিরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ঘড়িলাল গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী আব্দুর রব মিঠু বলেন, বেড়িবাঁধের ওপর মাটির রাস্তা। এই রাস্তাই এই ইউনিয়নের প্রধান সড়ক। কোথাও ইটের সোলিং আছে, কোথাও নেই। ইউনিয়নের ১২ গ্রামে যাতায়াতের প্রধান যান ভ্যানগাড়ি আর মোটরসাইকেল। তবে ভ্যানগাড়ি সবখানে চলে না। মোটরসাইকেল ছোট রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। মৎস্য খামারের জন্য কোনো খাদ্য ও অন্যান্য মালামাল আনতে হলে বেশি খরচ দিয়ে নদীপথে আনতে হয়। কষ্টের সঙ্গেই বসবাস আমাদের।
ঘড়িলাল বাজারের ব্যবসায়ী শাহানুর রহমান টুটুল বলেন, নদীপথে উপজেলা ও জেলা শহর থেকে মালামাল এনে বিক্রি করতে হয়। সময় লাগে বেশি। টাকাও বেশি লাগে। বিকল্প পথ নেই। তবে জনপদের ভেতরে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো যদি ভালো হতো; মানুষের দুঃখ-কষ্ট কমে যেত।
আংটিহারা গ্রামের শিমুল, সোহেল, মাসুদ, আবুল গাজী, জব্বার মোড়ল, মোস্তফাসহ একাধিক জেলে আক্ষেপ করে বলেন, যখনই নির্বাচন আসে তখনই নেতাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। রাস্তাঘাটসহ এলাকায় উন্নয়ন করবে- নির্বাচনের পর সব ভুলে যায়। এভাবেই কয়েক যুগ ধরে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। আর কত বছর গেলে আমরা এ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাব।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল আলম নান্নু বলেন, আমাদের ইউনিয়নের ২৭ কিলোমিটার সড়কের ১৫ কিলোমিটার একেবারেই চলাচলের অনুপযোগী। সম্প্রতি স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে, সেটি খুব ধীরগতিতে দায়সারাভাবে। যেটুকু সরকারি বরাদ্দ আসে সেটাও আবার জনপ্রতিনিধি যারা আছেন ঠিকঠাক না করে যে যেভাবে পারছে লুটপাট করে খেয়েছে। অভিযোগ করলেও কেউ কর্ণপাত করে না। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না থাকায় এখন ইউনিয়নটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হতে চলেছে। এলাকার উন্নয়নের জন্য আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় আনার দাবি জানাই।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আধুনিক এই যুগেও আমাদের ইউনিয়নে কোনো পিচের (পাকা) রাস্তা নেই।
এমআরএম