ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৫ জুলাই ২০২৫, ১৯ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

সকালে-দুপুরে ছেলের সঙ্গে কথা হয়, সন্ধ্যায় মৃত্যুর খবর পান ফয়েজের মা

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৪৬, জুলাই ১৪, ২০২৫
সকালে-দুপুরে ছেলের সঙ্গে কথা হয়, সন্ধ্যায় মৃত্যুর খবর পান ফয়েজের মা শহীদ ফয়েজের ছবি হাতে তার বাবা-মা। ছবি: বাংলানিউজ

আঁর হোলা সকালে মোবাইলো কল দি কথা কই আঁর তুন দোয়া চাইসে, দুফুরেও কল দিসে। হাইঞ্জের বেলা হিগার মৃত্যুর খবর ফাই— এই পুরো বাক্যটি ২১ জুলাই শহীদ ফয়েজের মা সফুরা বেগমের।

 

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চর আবাবিল ইউনিয়নের পশ্চিম ঝাউডগী গ্রামের তাজল ইসলাম বেপারী বাড়ির বাসিন্দা ও আলাউদ্দিন বেপারীর বড় ছেলে ছিলেন ফয়েজ। তার মায়ের বক্তব্য অনুযায়ী, ২১ জুলাই সকালে ফয়েজ তার মোবাইলে কল দিয়ে নিজের জন্য দোয়া চেয়েছিলেন। দুপুরেও কল করেছিলেন। সন্ধ্যায় তিনি তার ছেলের মৃত্যুর খবর পান।  

জুলাই আন্দোলনে ফয়েজের শহীদ হওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের স্ত্রী নুর নাহারের মোবাইলে কল করেন সফুরা বেগম। নাহার জানান, ফয়েজের মাথায় ও ঘাড়ে গুলি লেগেছে। এ কথা শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তিনি ফয়েজকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছেন। ছেলেও তাকে অনেক ভালোবাসতো। দেশ ও দশের জন্য আন্দোলনে গিয়ে তার ছেলে বীরের মতো মরেছে। কিন্তু এখন তার খোঁজ নেওয়ার মতো কেউ নেই।  

২০২৪ সালের ২১ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অন্যান্যদের মতো যুক্ত হন ফয়েজ। তিনি পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিলেন। স্ত্রী নাহার ও আড়াই বছরের ছেলে আবদুন নবী রাফিকে নিয়ে সাইনবোর্ড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। শহীদ হওয়ার প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে বিয়ে করেছিলেন ফয়েজ।  

জানা গেছে, সাইনবোর্ড এলাকায় আন্দোলন করার সময় মাথায় ও ঘাড়ে দুটি গুলিবিদ্ধ হন ফয়েজ। খবর পেয়ে তার ঠিকাদার আবুল কাশেম তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। পরে বাড়িতে পরিবারের লোকজনকে খবর দেওয়া হলে ২১ জুলাই রাতেই তার লাশ রায়পুরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। পরদিন (২২ জুলাই) দুপুরে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

এ ঘটনার কয়েক মাস পর ফয়েজের বাবা বাদি হয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে অন্তত ৮০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।

মামলায় বাদি উল্লেখ করেন, সারাদেশে কোটা বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে আন্দোলনকারীরা ফতুল্লা থানাধীন কুতুবপুর ইউনিয়নের ভূইগড় এলাকার পূর্ব শান্তিধরা রঘুনাথপুর আয়েশা কমপ্লেক্সের সামনে জড়ো হয়। সেখানে তার ছেলে ফয়েজও অংশ নেন। আন্দোলন পণ্ড করার লক্ষ্যে ৭০ থেকে ৮০ জন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করে। ছাত্র-জনতার ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায় তারা। এ সময় ফয়েজের মাথায় গুলি লাগে।

ফয়েজের বাবা আলাউদ্দিন বলেন, ২১ জুলাই এশার নামাজের পর আমার চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে আমি ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাই। প্রথমে ছেলের নম্বরে কল দিই। পরে ছেলের বৌকে কল দিই। সে জানায়, আমার ছেলের মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এ কথা শুনেই ধরে নিয়েছি, আমার ছেলে আর নেই। আমার ছেলের ঠিকাদার আবুল কাশেম তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। সেখানে মৃত্যু হয়। আমি রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজে যাই। চিকিৎসকরা দ্রুতই লাশ নিয়ে যেতে বলে। কাগজপত্র ছাড়া গ্রামের বাড়িতে লাশ নিয়ে আসি। আন্দোলনে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ যেভাবে গণহত্যা চালিয়েছে, আমি এর বিচার চাই। আমার ছেলেসহ সকল শহীদদের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করছি।

আলাউদ্দিন আরও বলেন, আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে। ফয়েজ সবার বড়। সে কাজ করে যে টাকা পাঠাতো, তা দিয়ে কোনোমতে আমাদের সংসার চলতো। এখন আমি নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাই। ফয়েজের স্ত্রী ও ছেলে আছে। নাতিকে নিয়ে ছেলের বৌ টঙ্গীর একটি বস্তিতে বসবাস করে।

জুলাই আন্দোলনে নিহতদের সরকারি সহযোগিতার বিষয়ে ফয়েজের বাবা আলাউদ্দিন জানান, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা এবং জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ফয়েজের ছেলের নামে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে।

ফয়েজের বাড়ির বাসিন্দা মনসুর আহমেদ বলেন, ফয়েজকে ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি, সে অমায়িক এবং ভদ্র স্বভাবের ছিল। পরিবারের লোকজন তার ওপর ভরসা করে চলতো। সে আন্দোলনে শহীদ হয়েছে। তার পরিবারের লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সরকার যাতে তার পরিবার এবং তার ছেলে সন্তানের দিকে নজর দেয়।

ফয়েজদের এলাকার গ্রামীণ আঞ্চলিক সড়কটি হায়দারগঞ্জ-ঝাউডগী সড়ক নামে পরিচিত। ওই সড়ক শহীদ ফয়েজের নামে নামকরণের দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা। প্রতিবেশী মনির হোসেন বলেন, ফয়েজ একজন জুলাই যোদ্ধা। তার স্মৃতি ধরে রাখতে আমাদের আঞ্চলিক সড়কটির নাম শহীদ ফয়েজের নামে নামকরণের দাবি জানাচ্ছি।

উত্তর চর আবাবিল ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি আবদুল গনি বলেন, ফয়েজ জামায়াত ইসলামের সমর্থক ছিল। জুলাই আন্দোলনে গিয়ে তিনি শহীদ হয়েছেন। তাই দলের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। ফয়েজের বাবাকে এক লাখ এবং শিশু সন্তানের জন্য তার স্ত্রীর হাতে এক লাখ টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। শহীদ পরিবারটির জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।