ঢাকা: ২০১০ সালের ৯ এপ্রিল। সেদিন যশোরের বেনাপোল থেকে গ্রেপ্তার হন এক সময়ে ঢাকার খিলগাঁও-রামপুরা এলাকা কাঁপিয়ে বেড়ানো শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাজাদা ওরফে সাজু।
গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইনি প্রক্রিয়ার জামিনে বেরিয়ে যাওয়া তালিকাভুক্ত ১১ শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে তিনিও আছেন।
তাদের কয়েকজনের বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে বাংলানিউজ। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে ছিল খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন ও ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলালের প্রসঙ্গ।
দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে থাকছে শাহাজাদা ওরফে সাজুসহ তিনজনের প্রসঙ্গ। বাকি দুজন হলেন, খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ও সোহেল রানা চৌধুরী ওরফে ফ্রিডম সোহেল।
কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে মুক্তি পান শাহাজাদা ওরফে সাজু। খোরশেদ আলম ওরফে রাসু মুক্তি পান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। আর সোহেল রানা চৌধুরী ওরফে ফ্রিডম সোহেল কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান।
শাহজাদার ডাকনাম সাজু। কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়ার পর তার এক সময়কার আস্তানা হিসেবে পরিচিত রামপুরা, খিলগাঁও তালতলা, উত্তর গোড়ানের বাগানবাড়ি, শান্তিপুর স্কুল, হাউয়াই গলি ও নন্দীপাড়া এলাকায় তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকাশ্যে তাকে না দেখা গেলেও এলাকার কিছু সন্ত্রাসী তার নাম ভাঙ্গিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছেন, খিলগাঁও ভূঁইয়াপাড়ার মিন্টু ও কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার হওয়া সিপাহীবাগ মদন গলির মকবুল। পুলিশ বলছে, মিন্টুর নামে ১৫টি ও মকবুলের নামের ২৭টি মামলা রয়েছে।
অন্যদিকে রাজধানীর শাজাহানপুর এলাকায় ফ্রিডম সোহেলকে দেখা গেলেও মৌচাক, মালিবাগ ও সিদ্ধেশ্বরীতে রাসুর উপস্থিতি সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি স্থানীয়রা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফ্রিডম সোহেল একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি ওই রাজনৈতিক দলের আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কোথায় আছেন শাহাজাদা
রামপুরা এলাকার জ্যেষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাহাজাদা মূলত ৯০ দশকের শুরুর দিকে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর হাত ধরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া করে থাকতেন।
রামপুরা উলন রোডের পাশাপাশি খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের পেছনে জিন্নাত আলী মেম্বার গলি এলাকায় এবং তালতলা মৌলভীটেক এলাকায় তিনি ভাড়া থাকতেন। সঙ্গে থাকতেন স্ত্রী। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট শাহজাদা।
স্থানীয়দের একজন বলেন, শুনেছি শাহাজাদা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এলাকায় তার উপস্থিতি দেখা যায়নি। তবে শোনা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে শাহাজাদা নাকি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বর্তমানে তিনি নেপালে আছেন। টাকার বিনিময়ে সবকিছুই করতে পারেন তিনি।
সাম্প্রতিক এক ঘটনার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে রামপুরা-বনশ্রীতে একটি হাউজিং কোম্পানি বাড়ির কাজ শুরু করার জন্য একটি জায়গার চারপাশে বেড়া দেয়। হঠাৎ সেখানে ভূঁইয়াপাড়ার সন্ত্রাসী মিন্টু ও মদন গলির আরেক সন্ত্রাসী মকবুল ৪০-৪৫ জনের একটি দল নিয়ে সেখানে হামলা চালায়। তারা সেখানে শাহাজাদার লোক বলে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলেন।
তবে শাহাজাদা তাদের পাঠিয়েছিলেন কি না বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ওই বেসরকারি হাউজিং কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এক কর্মকর্তা বলেন, কারো বিরুদ্ধে লাগতে আসিনি। ব্যবসা করতে এসেছি। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।
পরে ওই কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, আপনার ফোনে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাজাদা নামে কেউ চাঁদা চেয়েছেন কি না। প্রশ্ন শুনে এক-দুই সেকেন্ড তিনি চুপ থেকে বলেন, একদম মিথ্যা কথা। শাহাজাদা নামে কেউ আমার কাছে চাঁদা দাবি করেননি।
রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান আকন্দ বলেন, জেল থেকে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাজাদার নামে নতুন করে থানায় দুটি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুবই তৎপর তাকে গ্রেপ্তারের জন্য।
তিনি বলেন, প্রতিদিনই অভিযান চালানো হচ্ছে। এই অভিযানে তার সহযোগী মোল্লা সাকিবকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে জেলে আছেন। শাহাজাদাকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
থানার একটি সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে শাহাজাদা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বর্তমানে তিনি নেপালে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
হাউজিং কোম্পানির বাড়ি নির্মাণে বাধা সম্পর্কে জানতে চাইলে ওসি আতাউর রহমান আকন্দ বলেন, পুলিশ বলেছিল তাদের অভিযোগ দিতে। তারা বলেছিল পরে আসবে। কিন্তু আর আসেনি।
শাহাজাদার পরিচয় দেওয়া সন্ত্রাসী মিন্টু ও মকবুল সম্পর্কে জানতে চাইলে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. দাউদ হোসেন বলেন, সিপাহীবাগ মদন গলির মকবুলকে চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি জেল হাজতে আছেন। এ ছাড়া একাধিক মামলার আসামি ভূঁইয়া পাড়ার মিন্টুকে পুলিশ গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কেউ দেখেনি রাসুকে
শীর্ষ সন্ত্রাসী খোরশেদ আলম রাসু ওরফে রাসুর খোঁজ তার এলাকার কেউ দিতে পারেনি। মৌচাক, মালিবাগ ও সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় গিয়েও তার খোঁজ মেলেনি। সেখানকার লোকজনও তাকে দেখেনি। নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিদ্ধেশ্বরী এলাকার এক ব্যক্তি বলছিলেন, রাসু জামিনে মুক্তি পেয়েছেন শুনেছি। তবে তাকে সরাসরি দেখিনি।
মৌচাক মার্কেটের পেছনে অবস্থিত আনারকলি মার্কেট এক সময় রাসু নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি যখন কারাগারে ছিলেন, তখন তার এক স্বজন সেই মার্কেট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করতেন। তার সম্পর্কেও তেমন কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। থানায় নতুন কোনো অভিযোগও রাসুর নামে পড়েনি।
রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম ফারুক বলেন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম যে চালাবে, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। শুধু রাসু কেন, তিনি যে-ই হোন না কেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাস প্রতিরোধে সবসময় তৎপর রয়েছে। অভিযান চলমান।
রাসুর খোঁজ এবং তার সম্পর্কে থানায় কোনো অভিযোগ এসেছে কি না— জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, তার বিরুদ্ধে থানায় এখনো নতুন করে কোন অভিযোগ আসেনি, মৌখিকভাবেও আসেনি।
রাজনৈতিক দলের আশ্রয় চাচ্ছেন ফ্রিডম সোহেল
ফ্রিডম সোহেলের খোঁজে উত্তর শাজাহানপুর এলাকায় গিয়ে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানান, জামিনে বের হওয়ার পর ফ্রিডম সোহেলকে শাহজাহানপুর এলাকায় প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। উত্তর শাহজাহানপুর, শাজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে তিনি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তারা জানান, সোহেল এখন বাড্ডা এলাকায় থাকেন। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলে হাসিমুখে কথা বলেন। সরাসরি তার সন্ত্রাসী কার্যক্রম কারো চোখে পড়েনি। দেশের অন্যতম বড় একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে তাকে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে।
৮০ দশকের শেষ থেকে ৯০ দশকের শুরুর দিকে শাহজাহানপুর এলাকার আরেক সন্ত্রাসী জজ ও মামুনের সঙ্গী হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন ফ্রিডম সোহেল। স্থানীয়রা বলছিলেন, এবার জামিনে বের হওয়ার পর তিনি বড় একটি দলের রাজনৈতিক ছায়া ও আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহাঙ্গীর হাসান বলেন, কোনো সন্ত্রাসীকেই রেহাই দেওয়া হবে না। পুলিশের অভিযান সবসময় চলমান। তবে যতটুকু জানা যাচ্ছে, ফ্রিডম সোহেলের নামে নতুন করে কোনো অভিযোগ থানায় আসেনি।
জামিনে মুক্ত সন্ত্রাসীদের নিয়ে কী বলছে পুলিশ
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পেয়েছে। যারা বাইরে পালিয়ে ছিল, তারাও দেশে আসার চেষ্টা করছে। অথবা শোনা যাচ্ছে দেশে অবস্থান করছে।
তিনি বলেন, আমাদের পুলিশ বাহিনী শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ সব সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের জন্য দফায় দফায় অভিযান চালাচ্ছে। কোনো সন্ত্রাসীকে ছাড় দেওয়া হবে না।
পুলিশের সংকট কেটে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশের কাজের সংকট ছিল। এখন সেই সংকট প্রায় কেটে গেছে। সন্ত্রাসীরা পুলিশের সংকটময় মুহূর্তের সুযোগ নিয়েছিল। বর্তমানে পুলিশ সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কোন সন্ত্রাসীর ঠাঁই নেই।
তিনি বলেন, কারাগার থেকে যারা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, তারা যদি আবারো সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত হন, তাহলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। অবশ্যই গ্রেপ্তার করা হবে। শীর্ষ সন্ত্রাসী যারা জেল থেকে বেরিয়েছে, তাদের অনেকে আবারো সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে, এমন অভিযোগ আসছে এবং নতুন করে কিছু মামলাও হয়েছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, যত সন্ত্রাসী জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়েছে, তারা আবার গিয়ে হাজিরা দিয়েছে, এমন রেকর্ড নেই। এই সন্ত্রাসীরা জেল থেকে বের হলেই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে বের হওয়া সন্ত্রাসীরা কে কোথায়, কী করছেন, জানতে চাওয়া হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা প্রধান রেজাউল করিম মল্লিকের কাছে।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, জামিনে কারাগার থেকে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কে কোথায়, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্তদের গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান চলছে।
তিনি বলেন, কারাগার থেকে জামিনে বেরোনোর পর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নতুন করে অপকর্মে জড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। কারো কারো বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ চাঁদাবাজির মামলাও হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অবস্থান এখনো শনাক্ত করতে পারিনি। তবে আমাদের শতভাগ চেষ্টা চলছে।
আরও পড়ুন: টিটন ‘নিশ্চুপ’, পিচ্চি হেলাল আত্মগোপনে, ইমনের খবর নেই
বাংলদেশ সময়: ০০১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫
এজেডএস/আরএইচ