ঢাকা, বুধবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০২ জিলকদ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

রাখাইনে মানবিক করিডোর: যে কারণে বাংলাদেশে বিতর্ক

তৌহিদুর রহমান: ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০:৪৩, এপ্রিল ৩০, ২০২৫
রাখাইনে মানবিক করিডোর: যে কারণে বাংলাদেশে বিতর্ক সংগৃহীত ছবি

ঢাকা: বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোর দেওয়ার নীতিগত সম্মতি দেওয়া হয়েছে, এমন খবর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তা রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। করিডোর দিলে বাংলাদেশ নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়বে কি না তা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।

জানা গেছে, রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর জন্য মানবিক করিডোর দিতে বাংলাদেশের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলো জাতিসংঘ। সংস্থাটির এই প্রস্তাবে সম্মতিও দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে বেশ কয়েকটি শর্ত দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। যদিও শর্তগুলো তিনি খোলাসা করেননি।

অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, করিডোর নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। তবে জাতিসংঘ চাইলে ত্রাণ সরবরাহে লজিস্টিক সহায়তা দিতে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত।

করিডর নিয়ে যেসব শর্ত: 
রাখাইনে অবস্থানরত নাগরিকরা খাদ্য ও ওষুধ সঙ্কটে ভুগছে। সে কারণে রাখাইনে মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতেই করিডোরের প্রস্তাব দিয়েছে জাতিসংঘ। তবে রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি শর্ত জাতিসংঘকে দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি, সবার জন্য সমানভাবে ত্রাণ বিতরণ, শর্তহীন ত্রাণ বিতরণ। এসব শর্ত না মানলে মানবিক করিডোর দিতে রাজি নয় বাংলাদেশ।

কোন পথে করিডোর?
মিয়ানমারের সঙ্গে কোন পথে করিডোর হবে, সেটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। স্থল ও নৌ উভয় পথেই করিডোর হতে পারে। এছাড়া মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। এই পথেও করিডোর দিয়ে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো সম্ভব। তবে রাখাইনে কোন পথে মানবিক সহায়তা যাবে, সেটা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো আলোচনা হয়নি।

করিডোর বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা:
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে করিডোর দেওয়ার প্রস্তাব থাকলেও তা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খুব সহজেই এই করিডোর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কেননা এই করিডোরের জন্য মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি উভয়পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন। এক পক্ষ রাজি না থাকলে এই করিডোর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এখন উভয় পক্ষ রাজি হবে কি-না সেটা কেউ নিশ্চিত নন। এটা আলোচনার মাধ্যমেই কেবল সম্ভব।

রাজনীতিতে উত্তাপ:
রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার বিষয়ে দেশের রাজনীতিতেও উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল করিডোর দেওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ ছিলো। কেননা এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা জড়িত। সরকারের উচিত ছিল এ বিষয়টা নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলা। তারা এটা না করে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে হিউম্যান পেসেজ (মানবিক করিডোর) দিচ্ছে।

বিএনপির পাশাপাশি গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকেও মিয়ানমারে করিডোর দেওয়ার বিষয়ে  রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারকে আলোচনার আহ্বান জানানো হয়েছে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যা বলছেন:
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, রাখাইনে মানবিক সহায়তার চ্যানেল হবে। কিন্তু এটার ব্যাপারে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সেসব শর্ত পালিত হলে আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করব। তবে শর্তগুলো তিনি স্পষ্ট করেননি।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যা বলছেন:
করিডোর প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ বিষয়ে একটি প্রশ্নোত্তরমূলক পোস্ট করেন তিনি।

তিনি বলেছেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, সরকার জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে তথাকথিত মানবিক করিডোর নিয়ে আলোচনা করেনি। মানবিক করিডোর নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান হলো, যদি রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের নেতৃত্বে কোনো মানবিক সহায়তা দেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশ তার লজিস্টিক সহায়তা দিতে আগ্রহী থাকবে।

প্রেস সচিব বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, বর্তমান বাস্তবতায়, রাখাইনে সহায়তা পাঠানোর একমাত্র কার্যকর রুট হচ্ছে বাংলাদেশের মাধ্যমেই। সে অনুযায়ী, এই রুট দিয়ে ত্রাণ সরবরাহে লজিস্টিক সহায়তা দিতে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত।

‘যদিও এখন পর্যন্ত রাখাইনে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ যোগাযোগ রাখছে। এক্ষেত্রে সময়মতো বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গেও পরামর্শ করা হবে।  

বিশ্লেষকরা যা বলছেন:
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে করিডোর হলে সেখানে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেখানে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এখন মিয়ানমার সরকার যদি দেখে এই করিডোরের ফলে আরাকান আর্মি লাভবান হচ্ছে। তখন তারা কি বসে থাকবে? তখনই সমস্যাটা তৈরি হবে। তখন এই করিডোরই আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে।  

তিনি আরও বলেন, বঙ্গোপসাগর এলাকা দিয়েও রাখাইনে ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তা সামগ্রী পাঠানো সম্ভব। তাহলে কেন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এই করিডোর দেওয়া হবে?

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সেখানের নাগরিকরা তীব্র খাদ্য সঙ্কটে ভুগছেন। বাংলাদেশ থেকে একটি করিডোর দিয়ে তাদের জন্য খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি, সার, বীজ, ওষুধসহ ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে চায় জাতিসংঘ।

টিআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।