ঢাকা, শুক্রবার, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৬ মে ২০২৫, ১৮ জিলকদ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বাংলাদেশ রাখাইন যুদ্ধের পার্ট হলে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়বে

বাংলানিউজ টিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:২১, মে ১৫, ২০২৫
বাংলাদেশ রাখাইন যুদ্ধের পার্ট হলে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়বে

রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ের পর রাজ্যটির সিংহভাগই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এই রাজ্যে জান্তা বাহিনীরই গণহত্যার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন লাখ লাখ রোহিঙ্গা।

কক্সবাজারে সেই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গত রমজানে ইফতার করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এর মধ্যে হঠাৎ রাখাইনে দুর্গতদের কাছে আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার আলোচনা সামনে এসেছে। এমনকি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অনুষ্ঠানে সেনাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি রাখারও আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসব বিষয়ে নানা পর্যালোচনা-পর্যবেক্ষণ চলছে সচেতন মহলে।

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কোনপথে, রাখাইনের গৃহযুদ্ধের উত্তাপ যেতে পারে কতদূর, মানবিক করিডোরের লাভ-ক্ষতি কী, ড. ইউনূসের যুদ্ধ প্রস্তুতিবিষয়ক বক্তব্যের তাৎপর্য কী, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই বাংলাদেশ রাখাইন যুদ্ধের কোনোভাবে পার্ট হয়ে গেলে বহুলকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কী—এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে। চলমান এসব বিষয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা হয়েছে গবেষক, শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর। বিশেষ এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু। তাকে সহযোগিতা করেছেন সিনিয়র রিপোর্টার পিংকি আক্তার।



বাংলানিউজ:
বাংলাদেশে হঠাৎ করেই আলোচনায় ‘মানবিক করিডোর’। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বললেন, সরকার নীতিগতভাবে করিডোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরে আবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বললেন, জাতিসংঘ বা কারও সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি। আসলে বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: আসলে এটা হাইলি-সেনসেটিভ (অত্যন্ত স্পর্শকাতর) একটা ইস্যু, তাই হয়তো সরকার এখনই এটা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে চাইছে না। তবে আমি মনে করি, যেহেতু দেশে এখন পার্লামেন্ট নেই তাই গণতান্ত্রিকভাবে এ বিষয়ে আমরা স্পষ্ট উত্তর পাচ্ছি না। কারণ এখন জবাবদিহির জায়গাটা ঠিকভাবে হয়ে ওঠেনি। আসলে সরকার যত কথার মারপ্যাঁচই দিক না কেন, করিডোরের বিষয়টি অসত্য নয় এবং বাংলাদেশ নীতিগত দিক থেকে বিষয়টি চিন্তা করলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে হবে।

বাংলানিউজ: করিডোর দেওয়ার ব্যাপারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেছেন, ‘কিছু বিষয় সরকার পরিষ্কার হতে চাচ্ছে’- বিষয়গুলো কী বলে মনে করেন? 

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: পারসেপশনের ব্যাপার তো, এগুলো হয়তো তারাই ভালো বলতে পারবে।

বাংলানিউজ: করিডোর দিলে কারা লাভবান হবে বলে মনে করেন, আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গা সম্প্রদায় নাকি মিয়ানমার সরকার? 

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: সামগ্রিকভাবে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীরা এবং আরাকান আর্মি।  



বাংলানিউজ:
ভারতের নীতিগত সিদ্ধান্ত কেমন হতে পারে?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে, তাই তারা এই যুদ্ধে পার্টই হতে চাইবে না। বরং নিরপেক্ষ থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

বাংলানিউজ: করিডোরের ব্যাপারে চীনের ভূমিকা বা লাভ-ক্ষতির হিসাব কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: চীন মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারকে সবরকমের সহযোগিতা করে থাকে। চীন সবসময়ই মিয়ানমারকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের এই সংকট নিরসনে কতটা এগিয়ে আসবে তা বলা মুশকিল। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে যদি মিয়ানমারের যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে সমস্যা নিরসনে চীন মধ্যস্থতা করবে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।  

বাংলানিউজ: বিভিন্ন সময়ে আরাকানে খ্রিস্টান বা ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের গুঞ্জন বা আলোচনা হচ্ছে- আপনি কী মনে করেন? কুকি চিন, মিজো ও মনিপুরীরা কি ইহুদী নাকি খ্রিস্টান? তাদের সশস্ত্র যুদ্ধের অস্ত্রের যোগানদাতা কারা বলে মনে করেন?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: দেখুন এখন থেকে দুই হাজার ৭০০ বছর আগে ইসরায়েল থেকে ‘বনি মানাসা’ নামে একটা গোত্র এখানে এসে বসতি গড়েছে। যদি এটি আলাদা রাষ্ট্র হয় তবে সেটি জুডাহ, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং মুসলিম—এই চার জনগোষ্ঠী মিলিয়েই একটি রাষ্ট্র সেখানে হতে পারে। যেখানে মুসলিম সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। যুদ্ধ উপকরণ যারা দিচ্ছে তারা তো কখনোই স্বীকার করবে না, তবে এক্ষেত্রে ওয়েস্টার্ন কান্ট্রি অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক সমর্থন আছে।  

বাংলানিউজ: ভারত কি তাহলে তাদের দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আলাদা রাষ্ট্র গঠনে সম্মতি দেবে? মানে, তাদের দেশের মনিপুরী, মিজো কিংবা কুকি-চিনরা নতুন রাষ্ট্রে চলে গেলে ভারত কি নিরাপ্দবোধ করবে?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: এ বিষয়ে তাদের আঞ্চলিক নজরদারি আছে। তারা তাদের অখণ্ডতা বজায় রাখতে সর্বদা সচেষ্ট। আমাদের মত তথ্যের দিক দিয়ে অজ্ঞান অবস্থায় থাকতে চাইবে না।

বাংলানিউজ: এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কতোটুকু?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: বান্দরবান-কক্সবাজার অঞ্চল নিয়ে যদি টান পড়ে তাহলে আমাদের অখণ্ডতা খর্ব হবে।  

বাংলানিউজ: জামায়াত বিবৃতি দিয়ে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আলাদা রাষ্ট্রের কথা বললো, পরক্ষণেই আবার বিবৃতি দিয়ে সেখান থেকে সরে আসলো? এটা আপনি কীভাবে দেখেন?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: যেহেতু রোহিঙ্গারা ধর্মের দিক দিয়ে মুসলমান তাই হয়তো জামায়াত এমনটা করেছে। এখানে ইসলামী চেতনা কাজ করছে। এটা আসলে তারা সেইফ জোন তৈরি করতেই এমন প্রস্তাব দিয়েছে, এটা মানবতারও একটি অংশ। পরক্ষণে কেন সরে আসলো, এটা তারা ভালো বলতে পারবে।  

বাংলানিউজ: বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, আমরা গাজা হতে চাই না। এই বক্তব্য দিয়ে উনি আসলে কী বোঝাতে চাইছেন?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: উনি বোঝাতে চেয়েছেন যে ফিলিস্তিনিদের মতো পরিস্থিতিতে আমরা পড়তে চাইছি না।  

বাংলানিউজ: বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের মহাসচিবের সামনে রোহিঙ্গাদের আগামী রমজান রাখাইনে পালনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, এটা কতোটুকু বাস্তব?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: এটা সম্ভব হতে পারে। তবে কাজটি মোটেও সহজ  হবে না। তারপরও আমরা আশা রাখতে পারি। আবার সেখানেও রোহিঙ্গাদের পরিবেশ ও নিরাপত্তা, অধিকার নিশ্চিত না করে আমরা তাদের পুশব্যাক করতে পারব না, সো ইটস টাফ (সেজন্য এটা কঠিন)। আমার ধারণা, এই সরকার অনেকদিন থাকবে ক্ষমতায়। আর এটিই হয়তো এখন জনগণও চায়, সুতরাং যতক্ষণ না পর্যন্ত এই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হচ্ছে, ততক্ষণ হয়তো এই সরকার ক্ষমতায় থাকবে। আমি বলতে চাচ্ছি সরকার ক্ষমতায় থাকার এটিও অন্যতম কারণ হতে পারে। সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য এটি একটি বড় বিষয় হয়ে যেতে পারে।  



বাংলানিউজ:
আরাকান আর্মি আসলে কারা? তারা কি রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রত্যাবাসন মেনে নেবে? এখনো কেন রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হচ্ছে? আর বাংলাদেশই বা কেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে? 

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: বাংলাদেশ আশ্রয় দিচ্ছে, কারণ না দিয়ে এখন আর উপায় নেই। প্রায় সিংহভাগ আমরা আশ্রয় দিয়ে ফেলেছি। আর আরাকান আর্মি তাদের ‘সান অব দ্য সয়েল’ (ভূমিপুত্র) মনে করে না, তারা মনে করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেরই। মানবিক কারণে আশ্রয় দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

বাংলানিউজ: সবশেষে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্ভব না হলে পরিস্থিতি কী হতে পারে?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: এখন আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার কেন্দ্রীয় সরকারের যেই যুদ্ধটা চলছে বাংলাদেশও হয়তো সেখানে একটা পার্ট হতে পারে। যদি তারা সীমান্ত অতিক্রম করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে হামলা করে বসে তাহলে তো বাংলাদেশ নিরাপত্তার স্বার্থে পাল্টা আক্রমণ করবে।  

বাংলানিউজ: করিডোর যদি সরকার দিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি কী হতে পারে?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: করিডোর তো অলরেডি দিয়ে দিছে। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধ যতদিন চলবে অনির্বাচিত সরকার বহাল থাকার সুযোগ তৈরি হবে।  

বাংলানিউজ: ড. ইউনূস সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেছেন, ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখছেন?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: প্রতিরক্ষামন্ত্রী (প্রধান উপদেষ্টার আওতায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়) হিসেবে হয়তো এটি বলেন, যাতে সৈনিকরা উৎসাহিত হয়। তবে যুদ্ধ যুদ্ধ সম্ভাবনাও তো কম না।  

বাংলানিউজ: ড. খলিলুর রহমানকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কেন করা হয়েছে? তিনি আসলে কী করছেন?

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: রোহিঙ্গা বিষয়টা তিনি দেখবেন তাই তাকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।  

বাংলানিউজ: রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে আগামী নির্বাচন ঘোষিত (সম্ভাব্য) সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া বা না হওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে বলে কি আপনি মনে করেন? 

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: পরিপূর্ণভাবে আছে, এ বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনের সময়। কারণ বাংলাদেশ যদি এই ইস্যুতে যুদ্ধের পার্ট হয় তবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তো আর নির্বাচন সম্ভব না। তখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় তো ডেফিনেটলি বাড়বে। আমরা তখন দীর্ঘকালীন সংকটের দিকে নিপতিত হব।
 
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।