ঢাকা: অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের একাদশতম আসর বসছে বাংলাদেশে। টেস্ট খেলুড়ে ১০টি দেশ ও আইসিসির ৬ সহযোগী সদস্য দেশকে নিয়ে জানুয়ারির ২৭ তারিখ থেকে দেশের চারটি ভেন্যুতে শুরু হচ্ছে এবারের আসর।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ যুব বিশ্বকাপ নামেও পরিচিত। এতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে যুবারা বিশ্বমঞ্চে প্রবেশের সুযোগ পান। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটারদের কাছে নিজেকে চেনানোর সবচেয়ে বড় মঞ্চ যুব বিশ্বকাপ।
যুব বিশ্বকাপ খেলে প্রতিভার দাপট দেখিয়ে পরবর্তীতে বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করেছেন- এমন উদাহরণ অহরহ। ১৯৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম যুব বিশ্বকাপ খেলে উঠে আসেন ইংল্যান্ডের নাসের হুসেন, মাইকেল আথারটন। অস্ট্রেলিয়ার স্টুয়ার্ট ল ও অ্যালান মুলালি। ভারতের স্পিনার ভেঙ্কাপতি রাজু ও নয়ন মোঙ্গিয়া। শ্রীলংকার সনাথ জয়সুরিয়া, রমেশ কালুভিথারানা ও চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। পাকিস্তানের আকিব জাভেদ, বাসিত আলী, ইনজামাম উল হক ও মুস্তাক আহমেদ। আরও উঠে এসেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা, জিমি অ্যাডামস, রিডলে জ্যাকবস। নিউজিল্যান্ডের ক্রিস কেয়ার্নস, অ্যান্ডি ক্যাডিক ও বাংলাদেশের আমিনুল ইসলাম বুলবুল। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ক্রিকেটাররা পরবর্তীকালে দীর্ঘ সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দাপট দেখিয়েছেন।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ধারণাটি আসে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের জেনারেল ম্যানেজার গ্রাহাম হালবিশের মাথা থেকে। ১৯৮৮ সালে গ্রাহামের ধারণার বাস্তবায়ন ঘটে। ভিক্টোরিয়া ও সাউথ অস্ট্রেলিয়াকে ভেন্যু বানিয়ে আটটি দলকে নিয়ে শুরু হয় যুব বিশ্বকাপের প্রথম আসর। দ্বিতীয় আসর গড়ায় ১৯৯৮ সালে। এর পর থেকে প্রতি দুই বছর অন্তর মাঠে গড়াচ্ছে যুবাদের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই-অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট।
যুব বিশ্বকাপের সব আসর:
১৯৮৮: অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আয়োজিত যুব বিশ্বকাপের প্রথম আসরে শিরোপা জেতে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট পরিবারের সাতটি দেশ (ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ) ও আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর (বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে, বারমুডা, কানাডা, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ড) ক্রিকেটারদের নিয়ে তৈরী করা হয় একটি দল। মোট আটটি দল অংশ নেয় প্রথম আসরে।
সিঙ্গেল লিগ পদ্ধতির এ টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তান। অ্যাডিলেড ওভালের ফাইনালে পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জেতে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট উইলিয়ামস ৪৭১ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরার হন। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ১৯টি উইকেট নেন মুশতাক আহমেদ।
১৯৯৮: দশ বছরের বিরতির পর দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসর। এতে অংশ নেয় ১৬টি দেশ। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতে ইংল্যান্ড। প্রথমবার অংশ নিয়েই প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ৩৬৪ রান করে টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইল। রামনরেশ সারওয়ান ও জিম্বাবুয়ের এনকালা যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেট (১৬টি) শিকার করেন।
২০০০: প্রথমবারের মতো এটি আয়োজিত হয় এশিয়ার দেশ শ্রীলংকায়। শিরোপাও থেকে যায় এশিয়াতেই। সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠের ফাইনালে শ্রীলংকাকে ৬ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জেতে ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ ৩৪৮ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও পাকিস্তানি বোলার জাহিদ সাইদ ১৫ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন। সিরিজ সেরা হন ভারতের যুবরাজ সিং।
২০০২: চতুর্থ আসর বসে নিউজিল্যান্ডে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জেতে অস্ট্রেলিয়া। অজি যুবারা সাত উইকেটে হারায় প্রোটিয়া যুবাদের। নেপালকে ১৩৭ রানের বিশাল ব্যবাধানে হারিয়ে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় জিম্বাবুয়ে।
৪২৩ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন অজি ব্যাটসম্যান ক্যামেরন হোয়াইট। ১৬ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন একই দলের জাভিয়ার ডোহার্টি।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের এই আসরের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ ঘটে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং স্টার হাশিম আমলা, বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্যারেন স্যামি ও ডোয়াইন ব্রাভো, ভারতে পার্থিব প্যাটেল ও ইরফান পাঠান, জিম্বাবুয়ের ব্রেন্ডন টেলর ও এলটন চিগুম্বুরা, ইংল্যান্ডের টিম ব্রেসনান ও সামিট প্যাটেল, নিউজিল্যান্ডের জেসি রাইডার, পাকিস্তানের উমর গুল ও আজহার আলী, শ্রীলংকার ধামিকা প্রসাদ ও উপল থারাঙ্গার।
২০০৪: প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আয়োজক হয় বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৫ রানে হারিয়ে শিরোপা জেতে পাকিস্তান। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় স্বাগতিক বাংলাদেশ।
ভারতের বর্তমান তারকা ব্যাটসম্যান শিখর ধাওয়ান টুর্নামেন্টে ৫০৫ রান করে সেরা রান সংগ্রাহক ও বাংলাদেশের এনামুল হক (জুনিয়র) ২২ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন।
এ আসর দিয়ে ইংল্যান্ডের অ্যালিস্টার কুক, লুক রাইট, রবি বোপারা ও ইয়োন মরগান। ভারতের সুরেশ রায়না, রবিন উত্থাপা ও দিনেশ কার্তিক। পাকিস্তানের ওয়াহাব রিয়াজ, নিউজিল্যান্ডের বিজে ওয়াটলিং, আয়ারল্যান্ডের উইলিয়াম পোর্টারফিল্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার ভারনন ফিল্যান্ডার, শ্রীলংকা অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিনেশ রামদিনরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নাম লেখান।
২০০৬: অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ষষ্ঠ আসর বসে শ্রীলংকায়। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে ৩৮ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো যুব বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে পাকিস্তান। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় নেপাল।
ভারতের চেতেশ্বর পূজারা ৩৪৯ রান করে হন সর্বোচ্চ সংগ্রাহক। ১৬ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন অস্ট্রেলিয়ার ময়েস রিকেস।
এ আসর দিয়ে বিশ্বের কাছে পরিচিত হন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম, ভারতের রোহিত শর্মা ও রবিন্দ্র জাদেজা, অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ার্নার, নিউজিল্যান্ডের মার্টিন গাপটিল, টিম সাউদি, ইংল্যান্ডের মঈন আলী।
২০০৮: এবার মালোয়েশিয়াতে বসে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আসর। দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। কিনরারা একাডেমি মাঠে বৃষ্টি-আইনে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১২ রানে হারিয়ে শিরোপা হাতে তোলেন বিরাট কোহলি। নেপালকে সাত উইকেটে হারিয়ে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
বিরাট কোহলি ছাড়াও এ আসর থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার পথ সুগম করেন ইংল্যান্ডের স্টিভেন ফিন, পাকিস্তানের উমর আকমল ও জুনায়েদ খান, শ্রীলংকার থিসারা পেরেরা।
২০১০: অষ্টম অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ আয়োজক নিউজিল্যান্ড। তৃতীয়বারের মতো শিরোপা জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে অজিদের কাছে ২৫ রানে হার মানে পাকিস্তান। আয়ারল্যান্ডকে ১৯৫ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।
এ আসর থেকে উঠে আসেন ইংল্যান্ডের জো রুট, জস বাটলার, বেন স্টোকসরা। দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি কক, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জ্যাসন হোল্ডার, অস্ট্রেলিয়ার মিশেল মার্শ ও নিউজিল্যান্ডের ডগ ব্রেসওয়েল উঠে আসেন।
২০১২: এবার অস্ট্রেলিয়ায় গড়ায় যুব বিশ্বকাপ। তৃতীয়বারের মতো ট্রফি জিতে নেয় ভারত। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ৬ উইকেটে হারায় তারা। আফগানিস্তানকে সাত উইকেটে হারিয়ে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলংকা।
বাংলাদেশের এনামুল হক বিজয় হন টপ স্কোরার। পুরো টুর্নামেন্টে ৩৬৫ রান করেন এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান। সর্বোচ্চ ১৯ উইকেট নেন চার বোলার। এরা হলেন-রিসি টপলি, তাসকিন আহমেদ, অ্যাস্টন অ্যাগার ও নজিবুল্লাহ জাদরান।
২০১৪: প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। চ্যাম্পিয়ন হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। দুবাই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাকিস্তানকে ৬ উইকেটে হারায় তারা। আর নিউজিল্যান্ডকে ৭৭ রানে হারিয়ে যুব বিশ্বকাপে চতুর্থবারের মতো প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দশম আসর থেকে উঠে আসেন কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার কাগিসো রাবাদা। যুব বিশ্বকাপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নাম লেখান এরা। দু’জনই বিশ্ব ক্রিকেটে এখন আলো ছড়াচ্ছেন।
বাংলাদেশ সময়:০৭৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৬
এসকে/এমজেএফ/