চট্টগ্রাম থেকে ফিরে: চট্টগ্রাম শহরে নেমে রিকশা-ট্যাক্সি-অটোরিকশা চালক অথবা পথচারী যে কাউকে আবেদীন কলোনির কথা বললেই সোজা গন্তব্যে নিয়ে যাবে। এই আবেদনী কলোনিতেই জন্ম নিয়েছেন দেশ সেরা দুই ক্রিকেটার নুরুল আবেদীন নোবেল ও মিনহাজুল আবেদীন নান্নু।
বড় ভাই নোবেল জাতীয় দলের সাবেক মারকুটে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান, যিনি বর্তমানে টাইগার হাই-পারফরম্যান্স দলের কোচ ও চট্টগ্রাম বিভাগের প্রধান কোচের দায়িত্বে আছেন। তবে ক্রিকেটের পাশাপাশি এ দেশের ফুটবলের স্বর্ণযুগ আশি-নব্বইয়ের দশকে ফুটবল মাঠেও তার দাপুটে পদচারণা ছিল।
তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজ নান্নু; বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক সময়ের দেশসেরা ব্যাটসম্যান। সাবেক অধিনায়ক নান্নু বর্তমান জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করছেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের হয়ে দেশের ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলেও খেলেছেন নান্নু।
শুধু নান্নু ও নোবেলই কেন? চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম সংলগ্ন লাভলেনের এই কোলানি থেকেই ৭০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে ব্যাট হাতে দাপট দেখিয়েছেন নোবেল-নান্নুর শহীদ পিতা শামসুল আবেদীন চৌধুরী ও তিন চাচা নাজমুল আবেদীন চৌধুরী, সেলিম আবেদীন চৌধুরী ও সুলতান আবেদীন চৌধুরী।
নান্নু-নোবেলের সাথে ক্রিকেট খেলতেন ফুপাতো ভাই সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, ফজলে বারি খান রুবেল, ফজলে রাব্বি খান সাজ্জাদ, চাচাতো ভাই ফজলে আহসান খান টিটু, শাকিল আবেদীন ও আহসানুল আবেদীন জনি।
চাচাতো ভাই ফজলে বারি খান রুবেল ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলও খেলতেন। ক্রিকেট ও ফুটবলের সঙ্গে পরিবারটির নিবিড় সম্পর্কের কারণে এই পরিবার থেকেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে চট্টগ্রামের আবেদীন ক্রিকেট ক্লাব টাউন ফুটবল ক্লাব।
ক্রীড়াই যে আবেদীন পরিবারকে পুরো চট্টগ্রামব্যাপী এমন সুনাম এনে দিয়েছে তা কিন্তু নয়। আর্থ-সামাজিক দিক থেকেও চট্টগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ আবেদীন পরিবার। দাদা জয়নাল আবেদীন ছিলেন জমিদার। মূলত তাঁর নামেই আবেদীন কলোনির নামকরণ করা হয়।
চাকরির সুবাদে দাদা জয়নাল আবেদীন ছিলেন তদানিন্তন ব্রিটিশ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা। জমিদারির পাশাপাশি ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের অগ্রগণ্যদের একজন। আজকের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামটি সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সেটার প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা ছিল জয়নাল আবেদীনের।
ক্রীড়া জগতের সঙ্গে আবেদীন পরিবারের সম্পর্কের কথা জানাতে গিয়ে নোবেল বলেন, ‘ছেলেবেলায় দেখতাম আমাদের পরিবারে দুটি ক্লাব আছে, আবেদীন ক্লাব ও টাউন ক্লাব। যখন দেখতাম এই দুই ক্লাবে সবাই খেলছে আমরাও তখন এম এ আজিজ ও পোলো গ্রাউন্ডে যাওয়া শুরু করলাম। ওখান থেকেই মূলত ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহটা জন্মেছে।
তখন থেকেই নেট প্র্যাকটিসে যেতাম। আর খেলতাম বাড়ির সামনের বিশাল উঠানে। খেলার সময় কাচ ভেঙে যেত আর দৌঁড় দিয়ে পালিয়ে যেতাম। পাড়ার সবাই আমাদের খেলা দেখতো। তখন ফুটবল ক্রিকেট এক সাথে হতো। ফুটবলের সময় ফুটবল আর ক্রিকেটের সময় ক্রিকেট। আমরা চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলও খেলেছি। ’
ক্রীড়া পরিবার হিসেবে বাবা ও চাচারা নোবেল-নান্নুকে পথ দেখালেও উৎসাহ দেয়ার ব্যাপারে মায়ের অবদানকেই এগিয়ে রাখলেন নোবেল। ‘বাবা চাচাদের পাশাপাশি আমার আম্মাও আমাদের প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। আমাদের খেলার টুকটাক সরঞ্জাম তিনিই কিনে দিতেন। জাতীয় দলে সুযোগ পেলে আম্মা খুব খুশি হতেন। জাতীয় দলের হয়ে বিদেশ সফরের সময় আম্মা বিমানবন্দরে এগিয়ে দিয়ে আসতেন। ১৯৮৬ সালে পাকিস্তান ট্যুরের কথা মনে আছে। আমরা দুই ভাই ছোট ছিলাম বলে আম্মা আমাদের সাথে একই ফ্লাইটে ওখানে চলে গিয়েছিলেন!’
সন্দেহ নেই পূর্বসূরিদের মতো উত্তরসূরি হিসেবে নান্নু ও নোবেল ক্রীড়ার সঙ্গে নিজেদের সস্পৃক্ত করেছেন। তবে পূর্বসূরিদের পারফরম্যান্স চট্টগ্রামের মধ্যে আবদ্ধ থাকলেও উত্তরসূরি হিসেবে নোবেল-নান্নু আবেদীন পরিবারকে নিয়ে গেছেন দেশের সীমানার বাইরে। ক্রিকেটে তাদের পদচারণা ৯ নং আবেদীন কলোনির নামকে করেছে আরও মহিমান্বিত।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১৬
এইচএল/এমজেএফ