ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

প্রত্যয়ী-পরিণত আশার ফুল!

মহিবুর রহমান, স্পেশাল করেসপনডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩, ২০১৮
প্রত্যয়ী-পরিণত আশার ফুল! মোহাম্মদ আশরাফুল। ছবি: শোয়েব মিথুন

ঢাকা: বিপিএলে ম্যাচ গড়াপেটার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে নিষিদ্ধ আশরাফুলের শাস্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আর মাত্র ৪ মাস ১০ দিন পর। চলতি বছরের আগস্টের ১৩ তারিখে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে পারবেন সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান।

মোহাম্মদ আশরাফুল ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরেছেন দুই বছর আগেই। কিন্তু লাল-সবুজের ক্রিকেটে যে মানুষটি আশার ফুল হয়ে ফুটেছিলেন সেই তিনিই এতদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চৌহদ্দিতে ঘেঁষতে পারেননি।

প্রিয় ক্রিকেট থেকে লম্বা একটি সময় নির্বাসিত জীবনের পর আবার মাঠে ফেরার আনন্দে এখন তিনি বিভোর। দায়মুক্তির আনন্দ বলে কথা! মুক্ত বিহঙ্গকে খাঁচায় আটকে রাখলে কিংবা পানি থেকে মাছকে ডাঙায় তুললে যে অবস্থা হয়, আশারাফুলের অবস্থাও ঠিক তেমন।

গেল ৫ বছরে অনেক কিছুই বদলেছে। তেমনি বদলেছেন ক্রিকেটের অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়া প্রতিভাবান এই ব্যাটসম্যান। পুরনো আশরাফুল ছিলেন অনেকটাই অস্থির, চঞ্চল আর অপরিণত। এখনকার আশরাফুল গোছালো ও পরিণত। বর্তমান আশরাফুলের মনে শুধুই পারফরম্যান্সের ক্ষুধা। যার কিঞ্চিৎ নিবারণ হয়েছে চলতি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ৫ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। শেষ তিনটি ছিল টানা।

এত চাপ; নির্বাসন থেকে ফিরে ভাবমূর্তি রক্ষার চাপ, ফর্মহীনতার চাপ তো ছিলই। ছিল বয়েসের চাপও। সব চাপ জয় করে আবার ব্যাটে দাপট দেখালেন আশরাফুল। এই দাপট আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে।

বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সে প্রত্যয় জানালেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের আশার ফুল। বলেছেণ নিজের আরো অনেক কথা। পাঠকদের জন্য সেই আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো।

বাংলানিউজ: লিগ শুরুর আগে একবারও ভেবেছিলেন ৫টি সেঞ্চুরি হাঁকাবেন?

আশরাফুল: অবশ্যই না। স্বপ্নও দেখিনি যে, ৫টি সেঞ্চুরি করবো। পর পর দুই ম্যাচে শূন্য রানে আউট হওয়ার পরের ম্যাচটাতে আমাকে বিশ্রাম দেওয়ার কথা উঠেছিল। ওই ম্যাচটা আমি জোর করেই ক্লাব অফিসিয়ালের কাছে চেয়েছি। তাকে বলেছি- ভাই, আমাকে এই ম্যাচে সুযোগ দেন, না পারলে তখন আপনারা আমাকে বিশ্রাম দিয়েন। তো পরের ম্যাচেই ৫০ করলাম, সেই ইনিংসে ১০২ রানে অপরাজিত থেকে অগ্রণী ব্যাংকের সাথে জিতলাম। তারপরের ম্যাচে আবার শূন্য রানে আউট হয়েছি। কিন্তু তারপর থেকে যেটা আমার কাছে মনে হয়েছে ৫০ রান করলে ১০০ করবো। যখনই ফিফটি করলাম তখনই ১০০ করার ইচ্ছে হতো। কারণ, আমার রান করার অভিজ্ঞতা আছে। যতগুলা ম্যাচই বিকেএসপিতে খেলেছি সবগুলো ম্যাচেই নিজের কাছে আলাদা আত্মবিশ্বাস ছিলো যে, আজ আমি রান করবো।

বাংলানিউজ: বিকেএসপিতে সাতটি ম্যাচ খেলেছেন। এর মধ্যে ৫টি সেঞ্চুরি ও ১টি ফিফটি। অন্য ম্যাচে ২৫। তাহলে কি বিকেএসপি আপনার জন্য লাকি গ্রাউন্ড?

আশরাফুল: না, ঠিক তেমন না। তবে কেন জানি না, যখনই খেলা হয়েছে মনে হয়েছে রান করবো। আগে হোক হোক আর পরে হোক। টস জিতি আর হারি। আবাহনীর সাথেও আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, তবে মিস করে ফেলেছি। আগে শ্রীলঙ্কার সাথে দেশের খেলা থাকলে এমন হতো। আমি যখনই ওদের বিপক্ষে ব্যাট করতে নামতাম মনে হতো ১শ’ করবোই! কেন এটা হয় আল্লাহ জানেন। তবে এটা ভালো অভ্যাস না। বদলাতে হবে।
মোহাম্মদ আশরাফুল।  ছবি: শোয়েব মিথুনবাংলানিউজ: টানা তিন সেঞ্চুরির আনন্দটা কেমন?

আশরাফুল: ক্রিকেটার হিসেবে এটা একটা বড় অর্জন। বাংলাদেশে প্রথম। যদিও দল ফল পায়নি। তবে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের বিচারে ভালো লেগেছে। তিনটির মধ্যে দুটিতেই অপরাজিত ছিলাম। আমার বিসিএলের অনুশীলনটাও হয়ে গেছে। যদি সুযোগ পাই।

বাংলানিউজ: আপনার ৫ সেঞ্চুরির চারটিতেই আপনার দল কলাবাগান ক্রীড়া চক্র জেতেনি। এটা কতটুকু কষ্টের?

আশরাফুল: না, কষ্ট পাইনি। কারণ, আমার দলটা ওতটা ব্যালান্স না। আপনি যদি দেখেন গত কালকের ম্যাচে বিকেএসপিতে শেখ জামাল ১৮৯ করেও ১০ রানে জিতেছে। তার মানে ওদের কোয়ালিটি বোলিং ছিল। আমাদের দলে ওই মানের বোলিংটা ছিল না। পুরো টুর্নামেন্টই দেখেন ১৩ ম্যাচে আমরা প্রথম ১০ ওভারে তিন উইকেট নিতে পারিনি। ব্যাটিংয়েও আমরা ওতটা ভালো ছিলাম না।

বাংলানিউজ: আপনি এত ভালো করার পরও দল অবনমনে চলে গেল, এটা আপনাকে কতখানি পীড়া দেয়?

আশরাফুল: এটা আমার জন্য একটি অভিজ্ঞতা। গত বছর আমার দল রেলিগেশনে পড়েনি। পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে। সুপার লিগ খেলতে পারিনি। ওটা আমার নিষেধাজ্ঞার পর প্রথম প্রিমিয়ার লিগ ছিল। এ বছর টিম রেলিগেশনে নামার আগেই অলরেডি প্রথম বিভাগে নেমে গিয়েছি। কষ্টতো অবশ্যই লাগে। এটা আমার জন্যও রেপুটেশনের ব্যাপার। আশরাফুল খেলেছে অথচ ওই দল নেমে গেছে!

বাংলানিউজ: সেঞ্চুরি করতে বেশি বল খেলেছেন, এটা একটা কনসার্ন কি না?

আশরাফুল: সবকিছু তো আর একবারেই হবে না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

বাংলানিউজ: আগামী ১৩ আগস্ট আপনার ওপর থেকে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে। এটা কতখানি আনন্দের?

আশরাফুল: অবশ্যই দারুণ আনন্দের। এই দিনের জন্যই গত ৫ বছর ধরে অপেক্ষা করছি। এটা উঠে যাবে, তখন আমি আবার বাংলাদেশ দলের বিবেচনায় আসবো, বিপিএল খেলতে পারবো। ঘরোয়া সব ক্রিকেটেই খেলতে পারছি, বিপিএল বাদ দিয়ে। নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে তখন আমার এই পারফরম্যান্সগুলো কাউন্ট হবে।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আশরাফুল।  ছবি: শোয়েব মিথুনবাংলানিউজ: প্রিয় ক্রিকেট ছেড়ে নির্বাসনে থাকা কতটা কষ্টের?

আশরাফুল: ভীষণ কষ্টের। তিন বছর ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে পারিনি। তারপর গেল দুই বছর ধরে ন্যূনতম ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে পারছি। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, এনসিএল, এবার বিসিএলও খেলেছি। আমি খেলাটা ভালোবাসি। বাংলাদেশ টিম মিস করি। গেল ৫ বছর বাংলাদেশ দলে খেলতে পারিনি, দলকে মিস করেছি।

বাংলানিউজ: এমন পারফরম্যান্সের পর নিশ্চয়ই জাতীয় দলে নিজেকে দেখতে চান?

আশরাফুল: এখনও সময় আসেনি। সময় এলে বলবো। এখন আমি যেখানে খেলি পারফর্ম করতে চাই। এমন পারফরম্যান্স করতে চাই যাতে মানুষের মুখে থাকি। এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু করতে চাই। বিসিএলে যদি সুযোগ পাই যেন ট্রিপল হান্ড্রেড মারতে পারি। তাহলে জাতীয় দলে ঢুকতে আরেকটি স্টেপ আগাবো।

বাংলানিউজ: সেই আশরাফুল ও এই আশরাফুলে পার্থক্য কতটুকু?

আশরাফুল: সেই আশরাফুল ও এই আশরাফুলের পার্থক্য অনেক। এখনকার আশরাফুল ফিটনেস নিয়ে সচেতন। যদিও আগেও আমি যথেষ্টই ফিট ছিলাম। এখন আমার শট সিলেকশন আগের চাইতে ভালো হয়েছে। শট কমেও গিয়েছে সত্যি কথা। যেমন এবারের প্রিমিয়ার লিগ থেকে পুল শট করে একটি রানও করিনি। সব ড্রাইভ বা স্কয়ার কাট জাতীয় শট থেকে রান করেছি। কিন্তু আমার ফেবারিট পুল শট। এই কাটডাউন মেনে নেয়া যে, আমাকে কষ্ট করে রান করতে হবে। আগে যেমন রাজকীয় স্টাইলে রান করতাম বা করার চেষ্টা করতাম। এবার শেষ ৬ ম্যাচে ওখান থেকে বের হয়ে কষ্ট করে রান করা শেখার চেষ্টা করেছি এবং মেনে নিয়েছি।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় আশরাফুল।  ছবি: শোয়েব মিথুনবাংলানিউজ: ভুল থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়। আপনিও নিশ্চয়ই নিয়েছেন?

আশরাফুল: মানুষ ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো সে বিষয়টি উপলব্ধি করছে কি না। আমি যে ভুল করেছি সেটা উপলব্ধি করে সাথে সাথে জাতির কাছে ক্ষমাও চেয়েছি। এখন বিষয় হচ্ছে তারা ক্ষমা করবে কি করবে না। যতদিন বেঁচে থাকবো চেষ্টা করবো যেন ভালো মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারি।

বাংলানিউজ: এবার আপনার বিপিএলের দ্বার উন্মুক্ত হচ্ছে। সেখানে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

আশরাফুল: এবারের বিপিএলের আগে আমি তিন চার মাস সময় পাব। এই সময়টা আমি সুপার ফিট হতে চেষ্টা করবো। বিপিএলে ভালো খেললে আমি বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলতে পারি। এটা আমার চ্যালেঞ্জ। এই তিন চার মাসে আমি আমার ফিটনেস ও স্কিল সেরা করতে চেষ্টা করবো।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৩, ২০১৮
এইচএল/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।