ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

পথে-ঘাটে সবাই এখন টিপস দেয়

মহিবুর রহমান, স্পেশাল করেসপনডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৮
পথে-ঘাটে সবাই এখন টিপস দেয় বাংলানিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তাসকিন আহমেদ। ছবি: ডিএইচ বাদল

২০১৪ সালের জুনে ভারতের বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫ ‍উইকেট নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে তাসকিন আহমেদের রাজসিক অভিষেক ঘটে। অবশ্য স্পটলাইটটা তার ওপরে ছিল আগে থেকেই। ২০১৩ সালে চিটাগং কিংসের হয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম বিপিএলে গতির ঝড় নজর কাড়েন তরুণ এই পেসার।

মাশারাফির পর আরো এক ‘গতি তারকা’ পাওয়া গেছে বলে সবাই আশাবাদী হয়ে ওঠেন। বোলিংয়ের সেই দাপট অব্যাহতভাবে ধরে রাখতে পারেননি তাসকিন।

এরই মধ্যে টেস্ট খেলার স্বপ্নও তার পূরণ হয়েছে। কিন্তু গেল বছরের অক্টোবরে দ. আফ্রিকা সফরে নির্বিষ তাসকিনকেই দেখা গেছে। শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই নয়, ঘরোয়া লিগেও নিজেকে খুঁজে ফিরছেন প্রতিশ্রুতিশীল এই ক্রিকেটার।

বাস্তবতা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে পথে-ঘাটে সবাই তাকে টিপস দিতে শুরু করেছেন। অবশ্য বিষয়টিতে নেতিবাচক কিছু দেখছেন না এই স্পিডস্টার। বরং ইতিবাচকভাবে নিয়ে আগামীতে নিজেকে ছন্দে ফিরে পাওয়ার মিশনে নেমেছেন তিনি।

সদ্য সমাপ্ত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে পিঠের ব্যথা তাকে ভুগিয়েছে বিস্তর। এখন তার লড়াইটা মুলত সেই ব্যথার সাথে। সেটা কাটিয়ে উঠে নতুন উদ্যমে মাঠে নামার প্রতীক্ষায় তাসকিন আহমেদ। প্রেরণা হিসেবে সঙ্গে আছে ফাস্ট বোলিং লিজেন্ড ব্রেট লির টিপস।
বাংলানিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তাসকিন আহমেদ।  ছবি: ডিএইচ বাদলবাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী ফাস্ট বোলার তাসকিন। কথা বলেছেন আরও অনেক বিষয়েই। পাঠকদের উদ্দেশ্যে সেই কথোপকন তুলে ধরা হলো।

বাংলানিউজ: তাসকিনের বর্তমান সময়টা কেমন যাচ্ছে?

তাসকিন: সত্যি কথা বলতে খেলাধুলার দিক থেকে মনের মতো যাচ্ছে না। একজন পেশাদার খেলোয়াড়ের খেলাটা যখন মনের মতো না হয় ব্যক্তিগত জীবনটাও কেমন জানি মনমরা হয়ে থাকে। আশা করি আগের চেয়ে ভালো খেলবো। জীবনের এই ১০-১২টা খারাপ ম্যাচ মানেই তো আর জীবন শেষ না। যতদিন বেঁচে থাকবো খেলার প্রতি ভালোবাসা, প্যাশন অবশ্যই থাকবে। আমার আসলে ছোটখাট ইনজুরিও ছিল। যা হয়তো আমাকে ভালোভাবে পারফর্ম করতে দিচ্ছিলো না।

বাংলানিউজ: যে কারণেই হোক ভালো খেলতে না পারাটা কী আপনার জন্য একটি চাপ? যেহেতু আপনার শুরুটা ছিলো রাজকীয়!

তাসকিন: অবশ্যই। যেহেতু আমাকে সবাই চেনে। দেশের প্রায় সব মানুষই ক্রিকেট ভালোবাসে। ভালো খেললে সবাই ভালো বলে, ভালো আচরণ করে এবং ভালোভাবে সাড়া দেয়। খারাপ খেললে অনেকে খারাপ কথা বলে, এগুলো শুনতে হয়। নিজের ব্যাপারে চারপাশ থেকে খারাপ শুনতে ভালো লাগে না। অনেক সময় অনেকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। কেন খারাপ খেলছো? দেখা যায় রিকশাওয়ালাও টিপস দেয়। বলে ভাই শর্ট বলটা কম করলে পারেন না? এই জায়গাটায় স্লোয়ার মারলে পারেন না? সবাই এখন উপদেশ দেয়। অবশ্যই সবাই আমার ভালো চায় বলেই দেয়। তবে মাঝে মাঝে নিজের কাছে খারাপ লাগে এই ভেবে যে, যেই দেখে সেই খারাপ বলছে, আমি কি এতই খারাপ হয়ে গেলাম?

বাংলানিউজ: আপনিসহ এ দেশের তরুণ পেসাররা ফোকাসড না। সমালোচনা আছে আপনাদের লাইন, লেংথ ঠিক নেই, বলে ভেরিয়েশনও নেই। দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে বিষয়টি কতখানি উদ্বেগের?

তাসকিন: তরুণ পেসাররা খেলতে খেলতে অভিজ্ঞ হবে। এবার লিগে আমার প্রতিপক্ষ দলে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের গতবারের ও এবারের বিশ্বকাপ খেলা কিছু কিছু বোলার দেখেছি। এরা খেলতে থাকলে, বিসিবি থেকে পেসারদের যে ক্যাম্প করানো হচ্ছে সেই ক্যাম্পে থাকলে এবং লিগ খেললে তাদের উন্নতি হবে। সত্যি কথা বলতে উন্নতির শেষ নেই।

বাংলানিউজ: আপনার বিবেচনায় বাংলাদেশের পেস বোলিং আক্রমণ কতখানি শক্তিশালী?

তাসকিন: সত্যি কথা বলতে মাশরাফি ভাই, মোস্তাফিজ, শফিউল, রুবেল, আল আমিন; আরো আছে, কামরুল ইসলাম রাব্বি, সাইফউদ্দিনসহ পাইপলাইনে অনেক ভালো পেসার আছে। এখন সবাই এক্সস্ট্রা কাজ করছে। অভারঅল কিন্তু আমাদের দেশে অনেক প্রতিভাবান পেসার আছে। ফর্ম ভালো-খারাপ হতেই পারে। তারা কিন্তু প্রমাণও করেছে তারা ভালো করতে পারে। আমরা যেমন বিশ্বকাপে ম্যাচ জিতিয়েছিলাম; আমি, মাশরাফি ভাই, রুবেল ভাই। এখন তো মোস্তাফিজ অসাধারণ খেলছে। আমার বিশ্বাস ২০১৯ বিশ্বকাপে অনেক ভালো কিছু হবে।

বাংলানিউজ: সম্প্রতি আপনি বোলিংয়ে রান খরচায় বেশ ব্যয়বহুল। এ সমস্যা শোধরাতে কাজ করছেন?

তাসকিন: এটা আমিও জানি। সমস্যাটা হচ্ছে যে, আমার ছন্দটা একটু খারাপ যাচ্ছে। আমি দ.আফ্রিকা সিরিজের আগে বোলিংয়ে টেকিনিক্যাল কিছু পরিবর্তন করেছিলাম। এরপর থেকে আমার লাইন-লেন্থে সমস্যা হচ্ছে। কারণ, আপনি যতই ভেরিয়েশন করেন আর যাই করেন লাইন, লেন্থ কিন্তু ঠিক থাকতেই হবে। এটা বেসিক। ফিটনেসের কারণে পেসটাও আমার একটু কমে গেছে। কারণ, আমার ইনজুরি আছে। বিষয়টি নিয়ে আমি আমার সিনিয়র প্লেয়ারদের সাথে কথা বলেছি, বিশেষ করে মাশরাফি ভাইয়ের সেঙ্গ। তিনি আমাকে বলেছেন, তুমি এখন ব্যথা নিয়ে খেলছো বলেই নিজের শতভাগ দিতে পারছো না। তুমি সুস্থ হও, ফিট হও। দেখবে যেটা চাচ্ছো সেটাই হচ্ছে। ফিটনেস অনেক বড় একটা ব্যাপার। মাশরাফি ভাই যেমন ব্যথা নিয়েও একটা জায়গায় বল করতে পারেন। তার শক্তির জায়গা হলো লাইন-লেন্থ। আমি একজন ফাস্ট বোলার। আমি যদি ১৪৫ কিলোমিটারের জায়গায় ১৩৬ কিলোমিটার বেগে বল করি এবং লাইন-লেন্থ ঠিক না থাকে তাহলে আমি ব্যয়বহুল হবো। এটাই স্বাভাবিক এবং তাই হচ্ছে।
বাংলানিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তাসকিন আহমেদ।  ছবি: ডিএইচ বাদলবাংলানিউজ: কোর্টনি ওয়ালশের মতো বিশ্বমানের একজন কোচ আপনাদের শেখাচ্ছে। ওনার কাছ থেকে কতুটু নিতে পেরেছেন?

তাসকিন: কোনো সন্দে নেই, তিনি তার দিক থেকে শতভাগ দিচ্ছেন। তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন। কোচ ভালো উপদেশ দেবে এটাই স্বাভাবিক। মাঠে ভালো বল করতে হবে আমাদেরই। আমরা যদি তা করতে না পারি আমাদের পাশাপাশি তাকেও দায়ী করা হবে। তো মূল ব্যাপার হলো আমারদের কাজটা ঠিক মতো করা।

বাংলানিউজ: আপনাকে এদেশের গতির তারকা বলা হয়। গতি দিয়ে বল করা আপনি কতখানি উপভোগ করেন?

তাসকিন: অবশ্যই গতিময় বোলিং উপভোগ করি। কিন্তু ইদানিং সব ক্রিকেটেই পিচটা ব্যাটিং সহায়ক হয়। আইপিএল, বিপিএল, সিপিএল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, যাই দেখেন না কেন।

বাংলানিউজ: গতির সাথে ভেরিয়েশন থাকলে কেমন হয়?

তাসকিন: খুবই ভালো হয়। সেটা নিয়েও কাজ করছি। দুই একটা অস্ত্র রেডিও করছি। কয়েকদিন পরে দেখাবো।

বাংলানিউজ: বলা যাবে কী অস্ত্র?

তাসকিন: না, বলা যাবে না। আগে হোক তারপরে বলবো। এখন বললাম পরে হলো না, সেটা বড় বিপদ হয়ে যাবে!

বাংলানিউজ: বিয়ের আগের তাসকিন ও পরের তাসকিনের মধ্যে পার্থক্য কী? পেশাগত জীবনে কোন পরিবর্তন এসেছে কি না?

তাসকিন: পার্থক্য, বিয়ের আগে প্রেম করতাম, এখন বউ হয়ে গেছে! পেশাগত জীবনে পরিবর্তন ততটা আসেনি। সাকিব ভাই, মাশরাফি ভাই, তামিম ভাই; তারাও বিবাহিত। কিন্তু পারফরম্যান্সের কারণেই তাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবন ভালো যাচ্ছে। বিবাহিত অবিবাহিত কোনো বিষয় না। তবে বিয়ে করে আগের চাইতে সুখে-শান্তিতে আছি। বাসায় যাই একটু তাড়াতাড়ি। আগে যেখানে রাত ১১টায় যেতাম এখন ১০টায় যাই। আগে বাবা-মা ফোন দিতেন, বাসায় আয়। এখন বউ ফোন দেয়। না যাওয়া পর্যন্ত বউ ফোন দিতেই থাকে... প্যারা... (হাসি)। তবে সত্যি কথা বলতে জীবনটা এখন অনেক সুশৃঙ্খলিত।

বাংলানিউজ: ক্রিকেটে আপনার পছন্দের ফরমেট কোনটি?

তাসকিন: সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট।

বাংলানিউজ: টেস্ট কেন নয়?

তাসকিন: টেস্টও পছন্দ করি কিন্তু ওই দুইটাই বেশি। ওয়ানডেতেই আমার উইকেট বেশি। টেস্টও আমি খেলতে চাই।  

বাংলানিউজ: ২০১৪ সালে ক্যারিয়ারের একেবারে প্রথম ওয়ানডেতে ৫ উইকেটের পর আর এমন বোলিং করতে পারেননি। কবে দেখা যাবে সেই তাসকিনকে?

তাসকিন: আবার হবে, ইনশাল্লাহ। অবশ্যই হবে। আর ৫ উইকেট পাওয়া ভাগ্যেরও ব্যাপার। ৪ উইকেট যেহেতু তিনবার পেয়েছি, আমার কপাল ভালো থাকলে একটা উইকেট পেতেই পারতাম। সেদিন আমি চিন্তা করছিলাম যে আমি যে ম্যাচগুলোয় ৪ উইকেট পেয়েছি, কী বল করে পেয়েছি? আমি লেন্থে বল করেছি, ইয়র্কার বল করেছি। স্লোয়ারে কয়টা উইকেট পেয়েছি? ভেবে দেখলাম কয়েকটি স্লোয়ার বলেই উইকেট পেয়েছি। পরে চিন্তা করলাম স্লোয়ারের অপশন বাড়াতে হবে। কাজটি আগে করলে ওই ৪ উইকেট ৫ উইকেটও হতে পারতো।

বাংলানিউজ: আপনারা স্লোয়ার পারেন, কাটার মারতে পারেন কিন্তু ইয়র্কার কেন পারেন না? শেখেন না নাকি অনীহা?

তাসকিন: অবশ্যই শিখি, অনুশীলন করি। আসলে অনেক সময় এমন অবস্থা দাঁড়ায় মাথা কাজ করে না। কঠিন পরিস্থিতিতে ভুল হয়ে যায়। কিন্তু এটা ঠিক করা সম্ভব যদি আমরা অনেক বেশি ম্যাচ খেলি। মাশরাফি ভাই কিন্তু ঠিকই ভালো করছেন।  

বাংলানিউজ: ফ্যাশন নিয়ে তাসকিন কতটুকু সচেতন?

তাসকিন: আমার স্টাইল করতে ভালো লাগে। আমি যখন বের হই স্টাইল করতে পছন্দ করি। ভালো কাপড় পড়ে একটু আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভালোই লাগে। আমি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ডাইহার্ট ফ্যান। বলিউডের ঋত্বিক রোশনের অনেক বড় ফ্যান। এই দুইটা মানুষকে অনেক পছন্দ করি।

বাংলানিউজ: নিদাহাস ট্রফিতে বাদ পড়ার পর ব্রেট লি কী পরামর্শ দিয়েছিলো?

তাসিকন: রানিং করে ওজন কমাতে বলেছে। স্প্রিন্ট ট্রেনিং ও কোর (পেটের কাজ) নিয়ে কাজও বেশি বেশি করতে বলেছে।

বাংলানিউজ: ব্রেট লির পরামর্শ পাওয়ার অনুভূতি কেমন?

তাসকিন: ভালো। ও আমার সাথে হোয়াটসঅ্যাপেও কথা বলেছে। অবশ্যই একজন ফাস্ট বোলার হিসেবে লিজেন্ড একজন ফাস্ট বোলারের উপদেশ পাওয়া আসলেই অন্যরকম আনন্দ!

বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৮
এইচএল/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।