ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

হতাশা, ডায়েট, স্মার্টনেস, বিয়ে, ইউটিউব- যেভাবে জ্বলল সূর্যের আলো

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০২২
হতাশা, ডায়েট, স্মার্টনেস, বিয়ে, ইউটিউব- যেভাবে জ্বলল সূর্যের আলো

সূর্য কুমার যাদব কি ‘টি-টোয়েন্টির ব্র্যাডম্যান?’ এমন প্রশ্ন প্রায়ই আসছে এখন। তার ব্যাটিংয়ের ধরন, ধারাবাহিকতা, বাউন্ডারি হাঁকানোর ক্ষমতা প্রশংসা কাড়ছে সবার; এনে দিচ্ছে সাফল্যও।

কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সূর্যের অভিষেক হয়েছে ৩০ বছর বয়সে। এর আগে লম্বা ও কঠিন এক পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি।  

কখনো কখনো জাপটে ধরেছে হতাশাও। সূর্য ঘুরে দাঁড়িয়ে আলো ছড়িয়েছেন- নিজের কঠিন পথের সংগ্রাম, প্রস্তুতির ধরন, স্ত্রীর সাহায্য অথবা প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেওয়ার কৌশল তিনি শুনিয়েছেন দ্য ক্রিকেট মান্থলিতে। নাগরাজ গোল্লাপুরিকে দেওয়া ওই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন মাহমুদুল হাসান বাপ্পি...

প্রশ্ন : একটু দেরি হয়ে গেল, তবুও জন্মদিনের শুভেচ্ছা। বয়স তো ৩২ হয়ে গেল, এই জন্মদিনে স্ত্রীর কাছ থেকে কী উপহার পেলেন?

সূর্য কুমার যাদব: সে আমাকে দশবার জিজ্ঞেস করেছে, ‘তোমাকে কী দেবো?’ আমি বলেছি, ‘আমি কিছু চাই না। শুধু সমর্থন করে যাও সবসময়। এটাই চাওয়া তোমার কাছে। ’

মুম্বাইয়ের ড্রেসিংরুমে যখন প্রথমবার ঢুকলেন- নিশ্চয়ই দারুণ কোন গল্প আছে?

হ্যাঁ, ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামেই। দলে আসার পর সেদিন আমার প্রথম অনুশীলন ছিল। অনূর্ধ্ব-২২ থেকে এসেছিলাম। মাঠে ঢুকতে কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। চারপাশে তাকিয়ে দেখি একটুও জায়গা ফাঁকা নেই। কোথায় বসবো? পরে চলে গেলাম ওয়ার্ম-আপ করতে।  

যখন আমার নেটে ব্যাট করার সময় আসলো- চেঞ্জ করার দরকার হলো। প্যাড পরতে হতো, আরো কিছু ব্যাপার ছিল। স্যার (টেন্ডুলকার) তখন গনেশ মূর্তির পাশে বসে ছিল ড্রেসিং রুমে। উনি আমাকে বললেন, ‘এই চেয়ারটা ফাঁকা, এখানে বসতে পারো। ’ আমি শুধু বললাম ঠিক আছে।  

আমার দ্রুত সবকিছু বদলাতে হতো, নেটে ওই প্রথম অনুশীলন ছিল; তাই একটু বাড়তি তাড়াও ছিল। আমি খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম। স্যার সেদিন আমাকে যেখানে বসতে বলেছিল, যখনই ড্রেসিং রুমে যাই; আজ অবধি ওখানেই বসি।  

আপনার কি অনূর্ধ্ব-১৬ এর একটা ম্যাচে ৪০ বলে ১৪০ রানের ইনিংসের কথা মনে আছে? আপনার প্রথম কোচ আশুক আসওয়ালকার বলেছেন, ওই ইনিংস দেখে নাকি বয়সভিত্তিক পর্যায়ের এক নির্বাচক বলেছিল, ‘কীভাবে এত বড় বড় ছক্কা মারো?’

(হাসি) ওই ম্যাচটা ছিল লিগের, আমাদের জিততেই হতো। অধিনায়ককে বললাম, ‘তিনে ব্যাট করবো?’ সে বললো, ‘ঠিক আছে, গিয়ে উপভোগ করো। ’ আমি শুধু গিয়ে উপভোগই করছিলাম ব্যাপারটা। বাউন্ডারি ছিল ছোট, ওটাকেই কাজে লাগাচ্ছিলাম। এরপর এক নির্বাচক এসে বললো, ‘বয়সভিত্তিক ম্যাচে কীভাবে এত বড় বড় ছক্কা মারছো?’ আমি তাকে জবাব দিলাম, ‘এমনিতেই...’

ওই ব্যাটটা এখন কোথায়?

আমার কাছেই আছে। তিন-চারটা ব্যাট আছে অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭ পর্যায়ের। ওই ব্যাটগুলো আমার কোচ দিয়েছিল। যদিও সবগুলো ভেঙে গেছে, তবুও আমার কাছে আছে।

১০-১২ বছর আগে মুম্বাইয়ের পারফরম্যান্স অ্যানালিস্ট সৌরভ ওয়াকারের কাছে আপনি একটা ভিডিও চেয়েছিলেন। ১৯৯৪-৯৫ সালে জ্যামাইকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে স্টিভ ওয়াহর সেঞ্চুরির...

টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে, টেস্ট সব ফরম্যাটেরই দারুণ ইনিংসগুলোর ভিডিও আমি দেখি কারণ আমি দেখে শিখতে চাই ওই পরিস্থিতিতে তারা কী করেছেন। ব্যাটিংয়ে গেলে কীভাবে আরও ভালো করতে পারি, ইম্প্রোভাইস করা যায়, কীভাবে আমি ও আমার দল আরও উপকৃত হতে পারে এসব কারণেও ভিডিও দেখি। এই অভ্যাস তৈরি হয়েছে ২০১০-১১ সালের দিকে, যখন মুম্বাইয়ের হয়ে অভিষেক হয়; এখনও আমার সঙ্গে রয়ে গেছে।

নিজের ইনিংস দেখেন?

দেখি, হোটেলে ফিরে নিজের ইনিংস দেখাটা আমার পছন্দের কাজ। যদি এটা ভালো কিছু হয়- ধরুন, কোন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, আমি সেটাকে দুর্দান্তভাবে সামলে নিয়েছি; ওরকম ভিডিও বারবার দেখি।

কার্টলি অ্যাম্বরোসকে খেলছেন স্টিভ ওয়াহ, এরকম ভিডিও যখন দেখেন। মাথায় কী চলে?

আমি ওই ভিডিওগুলো দেখি আর খেয়াল করি ওয়াহ ব্যাটিংয়ে কী করছে। তার আচরণ কেমন ছিল? পাগলাটে ও দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুতগতির পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে তার ইন্টেন্ট কেমন ছিল?

একটা শব্দই ওই ভিডিও থেকে নেই- অ্যাটাক। এটাই একমাত্র ব্যাপার আর এভাবেই আমি রঞ্জি ক্যারিয়ারের শুরু করেছিলাম। সবসময় মনে হতো অ্যাটাকই হচ্ছে আমার সেরা ডিফেন্স। পরিস্থিতি যেমন হোক, চেষ্টা করতে হবে। চাপ প্রতিপক্ষের ওপর দিয়ে দেখতে হবে আপনার দিকে কী আসে।

রঞ্জিতে আপনার প্রথম অধিনায়ক ছিলেন ওয়াসিম জাফর। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, শুরু থেকেই আপনার একটা হার না মানা ব্যাপার ছিল। আপনি মুম্বাইয়ের প্রথাগত ব্যাটারদের মতোও ছিলেন না। আপনার প্রতি বিশ্বাস আনার ব্যাপারটা কেমন চ্যালেঞ্জিং ছিল?

কিছুটা কঠিন তো অবশ্যই। অনেক কিছুই শুনতে হয়েছে। বলেছে মুম্বাইয়ের প্রথাগত ব্যাটার না, চারদিনের ম্যাচে এমন ব্যাটিং করলে হবে না। তবে আমি নিজের কাছে পরিষ্কার ছিলাম, ফরম্যাট যেমনই হোক আমি নিজেকে মেলে ধরবো। যেই ব্যাপার সঠিক মনে করবো সেটাই করবো। কারণ পরে আমি বলতে চাই না, ‘ওহ, ওর কথা শুনে ভুল করে ফেলেছি। ’ কোন কিছু ভুল হলে দোষটুকু নিজের ওপরই থাকুক, এটা চাইতাম।

আপনি এটার পেছনে দৌড়ালেনও...

 ঠিক, দৌড়েছি। এটা আমার জন্য কাজ করেছে। আমি নিজের মতো করে করতে চেয়েছি সবকিছু। আর এটা সত্যিই আমার জন্য কাজ করেছে।

বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করলেন, নির্বাচকরা ডাকলো না। ওই সময়টা কেমন কাটতো?

অনেক দূর ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই সময় নিজেকে চালিয়ে নেওয়া ভীষণ কঠিন। ‘তোমার সুযোগ আসবে, কঠোর পরিশ্রম করতে হয়’ এটাও বলা সহজ ছিল না। কারণ যাদের সঙ্গে দেখা হতো সবাই একই কথা বলতো- পরিশ্রম করে যাও, নিজেকে চালিয়ে নাও। এগুলো বলা অনেক সহজ কিন্তু বাস্তবতা আলাদা। প্রতি বছর আলাদা কিছু করতাম আর ভাবতাম, ‘আমি যদি এটা করি, কাজ হবে? আমি যদি ওইটা করি, কাজ হবে?’

আমার এখনও মনে আছে- ২০১৭-১৮ মৌসুমের পর আমার স্ত্রী দেবিশার সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার স্মার্ট কিছু করতে হবে। আপনি পরিশ্রম করেছেন, এতটুকু এসেছেন, এখন আবার আলাদা কিছু করে দেখতে হবে কী হয়।  

আমি আলাদাভাবে অনুশীলন শুরু করলাম। ২০১৮ সালের পর বুঝতে পারলাম আমার খেলায় কী করতে হবে। অফ সাইডে বেশি খেললাম। ডায়েট শুরু করলাম। আরও কিছু ব্যাপার করলাম যেগুলো আমাকে ২০১৮ সালের ঘরোয়া মৌসুম ও '১৯ এ এসে সাহায্য করলো। ২০২০ সালে এসে আমার শরীর পুরো আলাদা হয়ে গেল।  

সময় লেগেছে। কোনটা শরীরকে সাহায্য করবে, সঠিক পথে সামনে এগুবো কীভাবে এটা বুঝতে দেড় বছর লেগেছে। এক পর্যায়ে আমরা দুজনেই বুঝতে পারলাম, ঠিক পথে আছি। এরপর সবকিছু এমনিতেই হয়ে গেল। আমি জানতাম কী করতে হবে, কীভাবে অনুশীলন করবো।  

আগে শুধু অনুশীলনই করতাম। কখনো কখনো হতাশও হয়ে যেতাম। আমার মনে হতো বিন্দুমাত্র কোয়ালেটি নেই, অনেক কোয়ান্টেটি আছে। কিন্তু ২০১৮ সালের পর অনুশীলনে, ডায়েটে, নেটে সবকিছুতে কোয়ালেটি আসলো। আর এটা আমাকে সাহায্য করলো। এরপর পরিপূর্ণভাবে সব হলো, সব ফরম্যাটে রান পেলাম, আইপিএলেও। ধারাবাহিকতা আসলো আর অবশেষে দরজা ভাঙতে পারলাম।

হতাশা কি তখন বাড়িতেও নিয়ে আসতেন? বাবা-মা, পরিবার, বন্ধু বা জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব ফেলতো?

কখনো না। মাঠে যা হবে, সব সেখানেই থেকে যাবে। আমরা (সুরিয়া ও স্ত্রী) কখনো ঘরে ফেরার পর হতাশ থাকতাম না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো- আমরা সমাধান খুঁজতাম। হতাশ হয়ে পড়ে থাকার চেয়ে কীভাবে কাজ করলে আরও ভালো করতে পারবো। আমরা ভবিষ্যতে তাকাতাম ও উন্নতি করতে চাইতাম। ঘরে থাকলে কখনোই হতাশ থাকতাম না। দুজন একই পৃষ্ঠায় থেকেছি সবসময়।

তখন কি নিজেকে সতীর্থদের সঙ্গে তুলনা করতেন? যাদের সঙ্গে অনূর্ধ্ব-২৩ খেলেছেন তারা ততদিনে জাতীয় দলে খেলছে...

তাদের কথা ভাবতাম। এখনও মনে আছে অনূর্ধ্ব-২৩ বিশ্বকাপে লোকেশ রাহুল, জাসপ্রিত বুমরাহ, অক্ষর প্যাটেল, হারশালের সঙ্গে খেলেছি। তাদের অনেকেই তখন জাতীয় দলে খেলে ফেলেছে আর আমি ২০১৬ সালে এসে বিয়ে করি। স্ত্রীর সঙ্গে উপরে যে কথোপকথনের কথা বললাম, সেটা আরও দুই বছর পরের। ঠিক তুলনা কখনো করিনি। সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েছি, দুজন মিলে একসঙ্গে কোন কাজ করে এক ধাপ এগোতে পারি, একসময় নিজের চিহ্ন রাখতে পারি; এসব নিয়ে ভেবেছি।

ডায়েটের আগের দিনগুলো কেমন ছিল?

হায় ঈশ্বর! আমি জানতামই না ডায়েট কী বা কেমন। সবসময় মনে হতো যেটা খেলে ভালো লাগে ওটাই খাবো। ধরুন, একটা আইসক্রিম খাওয়ার পর আমার মনে হবে, ‘ওয়াও! খুব ভালো শেপে আছি। ’ এরপর আমরা যখন কথা বললাম, উপলব্ধি করলাম যেটা খাওয়ার পর ভালো লাগে সেটা ছাড়তে হবে। আমরা এমন কিছু করেছি আর ভেবেছি কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসতে। যেগুলো ভালো লাগবে সেগুলো বাদ দিয়ে অন্য দিকে চলো নীতিতে চলতে শুরু করলাম এরপর।

আপনার স্ত্রীকে কি তাহলে জীবনের কোচ বলবেন?

অবশ্যই। সে সবসময় আমাকে মাটিতে রাখে, ভালো করি অথবা খারাপ। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে আমি ভালো করে আসলাম- রুমে ফেরার পর সে বলবে, ‘আমার মনে হয় এটা খুব ভালো দিন ছিল। আজকের রাত উপভোগ করার সময় তোমার। আগামীকাল ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ’

২০২০ সালের অক্টোবরের ২৮ তারিখ তারিখ আপনার জন্য স্মরণীয় দিন। রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে ১৬৫ রান তাড়া করতে নেমে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে ৪৩ বলে ৭৯ রান করলেন। এর কয়েকদিন আগে একটা ভালো আইপিএল মৌসুমের পরও অস্ট্রেলিয়া সিরিজ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল...

কিছুটা কঠিন সময় তো ছিলই তখন। বিভিন্ন দেশের সতীর্থরা আমাকে বলতো, ‘তোমার সুযোগ আসছে, খুব ভালো করছো। ’ আমিও তখন অনেক রোমাঞ্চিত ছিলাম। কল্পনা করতাম, জাতীয় দলে খেললে এটা করবো, ওইটা করবো। কিন্তু এরপর যখন সুযোগ আসতো না, স্বাভাবিকভাবেই হতাশ হতাম।

ভারতের হয়ে অভিষেকের ব্যাপারটা কেমন ছিল...

ম্যাচের দিন রবি শাস্ত্রী আমাকে ডেকে বলল, ‘তুমি যেটা করতে পারো, সেটাই করো। বেশি ভাববে না, অ্যাটাক করবে। তাদের কে প্রথম পাঞ্চটা দিতে হবে...’ আমি তাকে বললাম, ‘জি স্যার, আমি চেষ্টা করবো। ’ ম্যাচের দিন তার কাছ থেকে এমন কিছু শোনা ছিল অনুপ্রেরণার।

নির্দিষ্ট করে বলতে পারবো না ম্যাচের দিন বলা কথা কতটুকু প্রভাব রেখেছে আমার ওপর। কিন্তু ওই দিন আমি লাঞ্চ করছিলাম, শাস্ত্রী আমাকে কল দিয়ে বললো, ‘তুমি খেলছো, তোমার অভিষেক হচ্ছে। ’ ‘ওয়াও! এতদিন ধরে আমি তো এই দিনের অপেক্ষাই করছিলাম!’ আমার প্রতিক্রিয়া ছিল এমন।  

আপনার অনুভূতি কেমন ছিল প্রথম শোনার পর?

আমি তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম, স্ত্রী সঙ্গে ছিল। সে বললো, ‘তোমার ফোন বাজছে। ’ আমি কল ধরলাম আর শাস্ত্রী বললো, ‘নিচে এসো, আমি পুলের পাশে বসে আছি। ’ তখনই আমার মনে হচ্ছিল বস ভালো কোন খবর দেবেন। আমি তার কাছে গেলাম আর উনি বললো তুমি খেলছো। পরের দুই তিন-মিনিট উনি যা কিছু বলেছে, আমি শুনিনি; কানের একদিকে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। নিজেই ভাবছিলাম, ‘কীহ!? আমার অভিষেক হচ্ছে!’ তখন উনি বললো, ‘শুধু উপভোগ করো, ভয়ডরহীন থাকো, নিজেকে মেলে ধরো। ’ মাঠে যাওয়ার জন্য আর এক মিনিট অপেক্ষা করতেও ভালো লাগছিল না তখন।

এরপর রুমে ফিরে স্ত্রীকে কী বললেন?

সে রীতিমতো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো (হাসি)। বাবা-মাকে কল দিলাম টিম বাসে থেকে। তারা আমার অভিষেক প্রত্যাশা করেনি। কারণ ওই ম্যাচটা দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় ছিল সিরিজের। উনারা ভেবেছেন আমি হয়তো সিরিজ নির্ধারিত হওয়ার পর সুযোগ পাবো। বাবা অফিস থেকে দ্রুত চলে এসেছিলেন, উনি খুব রোমাঞ্চিত ছিলেন।  

এরপর আপনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম বলেই জোফরা আর্চারকে হুক করে ছক্কা হাঁকালেন!

 ওই যে, ফার্স্ট পাঞ্চ!

কীভাবে পারেন ভাই?

আরে খুব জরুরি ছিল তো! প্রথম পাঞ্চ খুব গুরুত্বপূর্ণ!

আপনি কি তাহলে আগেই ভেবে রেখেছিলেন এই শট খেলবেন?

সত্যি বলতে, না। আমি যখন রুমে ফিরে গেলাম অভিষেক হবে জানার পর। স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করছিলাম যে আমার অভিষেক হচ্ছে ৩০ বছর বয়সে। তাই পরের সুযোগ কখন আসবে, আমার কী করা উচিত এগুলো ভাবলে চলবে না। আমি আট-দশ বছর আইপিএল খেলে ফেলেছি ততদিনে, তাই ওই চাপের পরিস্থিতিটা জানি। আমার কেবল নিজের মধ্যে থাকতে হবে, কী করতে চাই বুঝতে হবে। আমি খুব পরিষ্কার ছিলাম। যদি আপনি দেখেন, যখন রোহিত আউট হয়, আমি রীতিমতো দৌড়ে পিচে গেছি। আমি শুধু মাঠে গিয়ে ভারতের জার্সি পরে ব্যাট করতে চেয়েছি, আর কিচ্ছু না।

আর আমার মাথার ভেতর একটা জিনিস চলছিল- আর্চার হয়তো ভাবতে পারে, ছেলেটার অভিষেক হচ্ছে, তাকে হার্ড লেন্থে করি, শর্ট বল। আমি তাই আগে থেকেই কিছুটা ঠিক করে রেখেছিলাম। জানি না সে ইয়র্কার মারলে কী হতো। ওই বলটার জন্য তৈরি ছিলাম, তবে শটের জন্য না।

রোহিত আউট হওয়ার পর দৌড়ে উইকেটে যাওয়ার কথা বললেন, এটা কী নার্ভাসনেস থেকে? 

আমার পেটে কিছু প্রজাপতি উড়ছিল, তাদের শান্ত করেছি এভাবে। দৌড়েছি, কিছুটা স্ট্র্যাচ করেছি, যতক্ষণে মাঠে পৌঁছেছি ওয়ার্ম-আপ হয়ে গেছে। আমি চাইনি সেখানে গিয়ে, স্ট্যান্স নিয়ে তারপর ওয়ার্ম-আপ করি। আমি নিজের প্রথম বলের আগেই ওয়ার্ম-আপ শেষ করতে চেয়েছি।

কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘প্রথম বল থেকে তোমাকে কীভাবে পুরো প্রস্তুত থাকো?’ আমি বলব, যখন ডাগ আউটে থাকি, কিছু না কিছু করি। লাফাই, শরীর নাড়াচাড়া করি। কারণ যখন মাঠে যাবো, আমি সময় অপচয় করতে চাই না। প্রথম বল থেকে...গো ফর ইট!

আর্চারের বিপক্ষেই আগের বছর আইপিএলে প্রথম বলে আপনি ধরাশায়ী হলেন, পরের বলে খেললেন রিভার্স স্কুপ। ওই দুইটা বল নিয়ে বলবেন?

আমি জানতাম সে সুপার ফাস্ট বোলার। কিন্তু আবুধাবির উইকেটে এমন দ্রুত বল আসবে প্রত্যাশা করিনি। যখন আঘাত পেলাম, দ্বিতীয় বলের আগে অবধি এটাই ভেবেছি, ‘পরের বলে আমাকে আলাদা কিছু করতে হবে। যদি আউটও হয়ে যাই, কোন সমস্যা নেই কিন্তু আমাকে কিছু একটা করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে আমিও এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে আসিনি।

আমি ওই শটটা (রিভার্স স্কুপ) কখনো খেলিনি আগে। একটা প্রস্তুতি ম্যাচে দুই-তিনবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কাজ হয়নি। তবে আমার ভাবনা ছিল, ‘এটাই হলো মঞ্চ, চেষ্টা করতে হবে। ’ এটা শুধু ব্যাটে লেগেছে, আমি এরপর পেছনে ফিরেও তাকাইনি। কারণ জানতাম যেভাবে ব্যাটে লেগেছে, অনেকদূর যাবে।

সৌরভ ওয়াকার আপনাকে একটা নাম দিয়েছে-জি সিনেমা। এটার রহস্য কী?

ঠিক। সে আমাকে ‘জি সিনেমা- অ্যাকশন, মাস্তি, ড্রামা’ বলে। কারণ আমার ইনিংসে এসব দেখতে পায়।

যখন আমি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট শুরু করি, আমরা একসঙ্গে বসে খেলা নিয়ে কথা বলতাম। কীভাবে স্পিনারদের আক্রমণ করবো, কোন উপায়ে পেসারদের। একদম ছোটখাটো বিষয় নিয়েও কথা বলতাম, যেমন- তুমি কি রঞ্জিতে এক মৌসুমে একটা সেঞ্চুরি করতে পারবে? দুই মৌসুমে দেড়শ? তিন মৌসুমে দুইশ?

যখন আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ‘তুমি তো মাস্তি করা মানুষ, মাঠে গিয়েও এভাবে খেলবে। ’ আমি খুব পরিষ্কার ছিলাম- মাঠের বাইরে কী করি, অনুশীলন কীভাবে করবো, যাই হোক ব্যাট করতাম, ম্যাচেও তাই।

আপনি বলছেন সবকিছু পরিকল্পনা করা?

ব্যাটিংয়ে নামলে আপনাকে পরিকল্পনা করতে হবে। শট নিয়ে করতে হবে, স্পিনারদের বিপক্ষে কোনটা খেলবেন, পেসারদের বিপক্ষে কেমন। কয়েকটা জায়গা আছে মাঠে- কোনদিক ছোট, কোনটা লম্বা, কোন পাশ আপনি লক্ষ্য বানাবেন। তো তিন চারটা বিষয় থাকে যেটা নিয়ে পরিকল্পনা করবেন, পড়াশোনা করতে হবে, এরপর ম্যাচে গিয়ে প্রয়োগ।

২০২২ সালের এশিয়া কাপের আগে টি-টোয়েন্টিতে ২৬ ইনিংসের আটটিতে প্রথস বলেই বাউন্ডারি মেরেছেন। এটাও কি পরিকল্পনা করেই?

না, এটা পরিকল্পনা না। একটু আগে এটাই বললাম- যতক্ষণে ক্রিজে পৌঁছাই দৌড়ে ওয়ার্ম-আপ শেষ করে ফেলি; রোমাঞ্চিত থাকি। যদি নিজের অথরিটি প্রতিষ্ঠা করতে হয়, প্রতিপক্ষকে বলতে হয় এখানে আমি কিছু একটা করতে এসেছি, রান করবো, আমাকে কী করতে হবে? আমি প্রথম বলে চার মারি, ছক্কা হাঁকাই অথবা হয়তো চেষ্টা করি প্রথম ছয়-সাত বলে দুই-তিনটা বাউন্ডারি মারতে। এটাই আমার খেলার ধরণ।

আমি যদি শুরুতে বাউন্ডারি না পাই, ঠিক আছে। সমস্যা নেই এখানে। আমি চেষ্টা করবো একটু পরে বাউন্ডারি মারতে কিন্তু উইকেট পড়ার পর যত দ্রুত সম্ভব চার বা ছক্কা হাঁকাতে ভালোবাসি। এটা চাপ দ্রুত প্রতিপক্ষের ওপর দিয়ে দেয় আর ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ আপনাকে।  

টি-টোয়েন্টিতে আপনার অনেক দারুণ ইনিংস আছে। এর মধ্যে এক-দুইটা বলবেন?

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই হাফ সেঞ্চুরি করেছিলাম, দলও জিতেছিল। এটা খু্ব বিশেষ ইনিংস ছিল আমার জন্য। এরপর আসবে সেন্ট কিটসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যেটা খেলেছি। উইকেট স্লো ছিল, ১৬৫ রান তাড়া করাও কঠিন ছিল; ইনিংসের উদ্বোধন করেছিলাম, পাওয়ার প্লের পরও চালিয়ে গেছি। কারণ আমি জানতাম নতুন ব্যাটার এসে রান করা হবে ভীষণ কঠিন। ১৪-১৫ ওভারে এসে বল পুরোনো হওয়ার পর রান তোলা কঠিন ছিল। অনেক বাতাসও ছিল তখন। ৭০ এর মতো রান করলাম (আসলে ৭৬)। দলও জিতেছে।  

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নাগপু্রে যেটা করেছি। ৬০-৬৫ রানের মতো করেছিলাম (আসলে ৬২)। অবশ্যই সেঞ্চুরিটাও আমার পছন্দের। কিন্তু যদি আমি শেষ করে আসতে পারতাম, তাহলে সেটা আরও উপরে থাকতো। আমি খুব খুশি ছিলাম প্রথম টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি পাওয়ায় কিন্তু আমার জন্য সুযোগ খুব কম ছিল।  

ট্রেন্ট ব্রিজে ওই ইনিংসের আপনি অদ্ভূত কিছু শট খেলেছিলেন। হার্ড লাইনে পড়ে শরীরে আসা বলও ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ওপর দিয়ে উড়িয়ে মেরেছেন। কীভাবে করলেন?

স্কুলে থাকতে রাবার বলে ক্রিকেট খেলেছি অনেক। তখন শক্ত সিমেন্টের উইকেটে খেলতাম। লোকজন এসে চাকিং করে যত জোরে করা যায়- তত জোরে বল মারতো। একদিকে বাউন্ডারি ৭৫-৮০ মিটার ছিল, আরেকদিকে ৭০ মিটার। যখন আপনি রাবার বলে সিমেন্টের ওপর খেলবেন- আপনার জন্য স্কুপ, পুল, আপার কাট করা, পয়েন্টের ওপর দিয়ে খেলা সহজ হয়ে যাবে। আমাকে যত শট খেলতে দেখেন উইকেটের স্কয়ারে অথবা পেছনে, ওই রাবার বলের ক্রিকেট থেকেই এসেছে এসব। আমি কখনো নেটে এসব অনুশীলন করিনি, বোলিং মেশিনের বিপক্ষেও না। সবকিছু ওখান থেকেই এসেছে।

অ্যাঙ্গেলগুলো কীভাবে তৈরি করেন?

যখন বল আপনার শরীরে আসবে- কোন বিকল্প থাকবে না তখন। হয় আঘাত সহ্য করতে হবে অথবা কোন কিছুর চেষ্টা। আমি দ্বিতীয়টিকেই বেছে নেই।

রবিন উত্থাপ্পা বলেছেন, আপনার একটা শক্তির জায়গা হচ্ছে শেষ মুহূর্তে স্ট্রোক বদলে ফেলতে পারেন। এটা কী সঠিক পর্যবেক্ষণ?

আমি আসলে বল করার আগেই দুই-তিনটা শট ভেবে রাখি। বোলার যদি এখানে বল করে, এই শটটা খেলবো। যদি ওখানে বল করে, ওই শটটা খেলবো। নন-স্ট্রাইকে থাকতেও আমি একই ব্যাপার ভাবতে থাকি। যদি বোলার ওই জায়গায় বল না করে যেখানে চাই, আমি আটকে যাই। কিন্তু আপনাকে মানিয়ে নিতে হবে। আমি ভাবতে থাকি আর নিজের ভাবনায় খেলি বাস্তবের আগেই।

আপনার প্রিয় শট কোনটা?

সুইপ।

২০১৬ সালে জ্যাক ক্যালিস আপনার কোচ ছিল কলকাতা নাইট রাইডার্সে। সে নাকি আপনার কাছে ল্যাপ শট শিখতে চেয়েছিল...?

ওহ, হ্যাঁ। মনে আছে। আমি তাকে অনেক সুইপ শট খেলতে দেখেছি, তো আমার মনে হচ্ছিলো সে কি সত্যিই এটা আমার কাছে শিখতে চাচ্ছে? আসলে কী হচ্ছে?

আমি তাকে বললাম এটা হয়েছে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন মাঠে খেলার কারণে। আমরা লাল মাটিতে খেলি, ওখানে আপনার হাতে বিকল্পই নেই যখন বল স্কয়ার টার্ন করবে, আমাদের ওই শট খেলতে হয়। সে তখন বললো, ‘তুমি কী পাগল!’ ওই সমময় আমি ডিপ মিড উইকেট থেকে ফাইন লেগ অবধি সুইপ খেলতাম। এখনও করি, কিন্তু তখন মাত্র শুরু করেছি। আর ক্যালিস বললো, ‘আমাকে শেখাবে?’ আমি পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে গেছি তার কথা শোনে।

এমনভাবে সুইপ শট খেলতে কী লাগে?

আমি বলের লাইনে যাই। বলটা প্যাডে নিতে পছন্দ করি। এটা দেখি না বলটা স্টাম্প লাইনের কি না- কারণ আমার মনে হয় সুইপ কিছুটা আগে থেকে ঠিক করে রাখা শট। বল করার আগেই আপনি ভেবে রাখবেন এমন। আমি খুব কম দেখি কেউ বলের লাইন দেখে তারপর শট খেলে। আমিও লাইন দেখি না- যদি ভাবি সুইপ করবো, করে ফেলি। আমি প্যাডে নেই এরপর এটা সহজ হয়ে যায় আমার জন্য।

৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটার ভাবা হয় আপনাকে। কাদের ভিডিও দেখেন?

সবার, কোন বিশেষ ক্রিকেটারের না। যেকারো ভিডিও দেখতে পছন্দ করি। কোন নির্দিষ্ট ধরনেরও না। এটা হতে পারে ওপেনার, তিন-চার নম্বর অথবা অন্য কোন পজিশনের ব্যাটার।

আমি আসলে পরিস্থিতি দেখতে পছন্দ করি। ধরুন, আমাদের দুই-তিন উইকেট গেছে দশ ওভারে, এরপর নয় করে দরকার প্রতি ওভারে। এমন পরিস্থিতিতে ওই ব্যাটার কী করেছে? নিজের ইনিংস কীভাবে গড়েছে? শেষ করেছে কীরকমভাবে? এসব জিনিস দেখি ও শিখি। আমি কীভাবে একই ব্যাপার করতে পারি? কীভাবে দলকে ম্যাচ জেতাবো? নিজে এমন কাজ কীভাবে করবো? চেষ্টা করি ইউটিউব দেখে কপি করতে।

বাংলাদেশ সময় : ১১১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০২২
এমএইচবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।