পৃথিবীর কোনো মানচিত্রেই কারাগারটির অস্তিত্ব নেই। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে মার্কিন সেনাবাহিনীর এটিই সবচেয়ে বড় সামরিক কারাগার।
বাগরাম একটি বিমানঘাঁটি। ওই বিমানঘাঁটিতেই রয়েছে গোপন সেই কারাগার। দূর থেকে ধূসর বর্ণের ভবনটি দেখে বিমানছাউনি বলেই মনে হয়। চারপাশে কংক্রিটের দেয়াল, সবুজ তেরপল দিয়ে ঘেরা পুরো ওই ভবন। ২০০২-এ অস্থায়ী কারাগার হিসেবে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। এর আগে একই স্থানে সাবেক সোভিয়েত বাহিনীর বিমানঘাঁটি ছিলো।
ইরাকের আবু গারাইব কারাগারের মতো এটার কুখ্যাতি এখনো ছড়ায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত ওই কারাগারে যে, জঘন্য ও বেআইনি কৌশল ব্যবহার হচ্ছে এবং সন্দেহভাজন কয়েদিদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। কয়েদিদের মুখে নির্যাতনের বর্ণনা থেকে তা সহজেই অনুমেয়।
আবু গারাইব--কারাগারে নির্যাতন-নিপীড়নের সমার্থক শব্দ। ২০০৪ সালে ইরাকি কয়েদিদের ওপর মার্কিন বাহিনীর নির্যাতনের গল্প সর্বপ্রথম প্রকাশ পায়।
ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন (ওএসএফ) নামে নিউইয়র্ক ভিত্তিক একটি সংগঠন সম্প্রতি বাগরাম বিমানঘাঁটির ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সংগঠনটি চালায়। ওই প্রতিবেদনে বাগরামের গোপন কারাগারে আটক কয়েদিদের উদ্ধৃত করে নির্যাতনের ধরন উল্লেখ করা হয়েছে।
এগুলোর মধ্যে আছে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে কয়েদিদের রাখা, ঘুমাতে না দেওয়া, ঘন অন্ধকারে রাখা বা নড়াচড়া বুঝতে না দেওয়া, অপর্যাপ্ত ও অখাদ্য খেতে দেওয়া, উলঙ্গ করা ইত্যাদি। কয়েদিরা ওই স্থাপনাটিকে ‘তর জেল’ বলে ডাকেন। পশতু ভাষায় তর-এর অর্থ কালো।
প্রতিবেদনে ওএসএফ আরও জানিয়েছে, ২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রতিরামন্ত্রী রবার্ট গেটস আফগানিস্তানে আটক নীতি ও প্রয়োগ নিয়ে একটি প্রক্রিয়া চালু করেন। আন্তর্জাতিক সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর প্রতি আফগান নাগরিকদের ক্ষোভ কমানোর উদ্দেশ্যেই এটি চালু করা হয়। মার্কিন আটক নীতির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমালোচনা মোকাবিলা করাও ছিলো এর উদ্দেশ্য।
বাগরামে গোপন তৎপরতা নিয়ে ওএসএফ-এর প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি মার্কিন সরকারি কর্মকর্তারা।
ওএসএফ প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তানের সরকার ওই গোপন কারাগারে নির্যাতনের ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করেছে। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বাগরামে অবৈধ আটক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তদন্ত করার আদেশ দিয়েছেন। তবে মার্কিন আধিপত্যের ছায়াতলে এই কমিটি বা প্রেসিডেন্ট কতটুকু কী করতে পারবেন সেটাই প্রশ্ন।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে গোপন কারাগার থাকার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছে। কমিটির বিবরণ অনুযায়ী, ৮০০-র বেশি কয়েদি সেখানে আটক রয়েছে।
নির্যাতনের কয়েকটি চিত্র
বাগরামে আটক কানাডার ওমর খাদর জানিয়েছেন, ‘সেনারা মেঝে ও আমার ওপর পাইনের তেল ঢেলে দেয়। এরপর হাত-পা একসঙ্গে বেঁধে আমার পেট মেঝের সঙ্গে টানাহেঁচড়া করে মূত্র ও তেলের মিশ্রণ পরিষ্কার করত। আমাকে ঝাড়– হিসেবে ব্যবহার করত। ’
বাগরামে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বন্দী খালিদ শেখ মোহাম্মদ। তিনি ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলে নিজেকে ঘোষণা দেন। প্রথমদিকে বাগরামের এবং পরে পোল্যান্ডের আরেকটি গোপন কারাগার হয়ে বর্তমানে তাকে গুয়ানতানামোতে রাখা হয়েছে। তার ওপর যৌন নিপীড়ন চালানো হয় বলে তিনি রেডক্রসকে জানান। তিনি বলেন, ‘আমাকে মেঝেতে শুইয়ে আমার পায়ুপথে টিউবের সাহায্যে পানি ঢোকানো হয়। ’
বাগরামের কয়েদিদের আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার কোনো অধিকার নেই। এর অর্থ হচ্ছে, আটকাবস্থার বিরুদ্ধে তারা কোনো আইনি আশ্রয় নিতে পারবেন না। মামলাগুলো নিরীক্ষার সুযোগও নেই। অনেকে বহু বছর ধরে আটক আছেন। কিন্তু জানেন না তারা কি কারণে আটক আছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১০