ভারতের দীর্ঘতম ও পবিত্র নদী গঙ্গা একসময় হাজার হাজার ডলফিনের প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর ছিল। এখন সেই নদীর বুকেই ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে প্রায় ৬ হাজার ডলফিন—যাদের অস্তিত্ব আজ মারাত্মক হুমকির মুখে।
গাঙ্গেয় ডলফিন ভারতের জাতীয় জলজ প্রাণী। এই ডলফিন সাধারণত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীব্যবস্থায় বাস করে। এরা আলাদা এক প্রজাতি—সামুদ্রিক ডলফিনের মতো পানিতে লাফিয়ে চলাফেরা করে না। চোখেও দেখতে পায় না বললেই চলে। এরা ঘোলা নদীর তলদেশ ঘেঁষে সাঁতার কাটে, প্রতিধ্বনির ওপর নির্ভর করে পথ খোঁজে।
সাম্প্রতিক এক সরকারি জরিপে দেখা গেছে, ভারতে নদীতে বসবাসকারী ডলফিনের সংখ্যা ৬ হাজার ৩২৭। এর মধ্যে ৬ হাজার ৩২৪টি গাঙ্গেয় ডলফিন, বাকি তিনটি সিন্ধু ডলফিন। সিন্ধু ডলফিন মূলত পাকিস্তানে বেশি দেখা গেলেও কিছু ভারতে চলে আসে, কারণ নদীটি দুই দেশ মিলে ভাগ করে নেয়।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এই দুই ধরনের ডলফিনকেই ‘বিপন্ন প্রাণী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারতের ‘ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট’র গবেষকরা ১০টি রাজ্যের ৫৮টি নদীতে জরিপ চালান। সেখানেই মেলে ভয়াবহ চিত্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, গাঙ্গেয় ডলফিন মূলত সামুদ্রিক ডলফিনের বিবর্তিত রূপ। লক্ষ লক্ষ বছর আগে প্লাবনের সময় ডলফিনেরা নদীতে এসে আটকা পড়ে এবং ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে নেয়।
এই ডলফিন প্রজাতির প্রজনন হারও কম। স্ত্রী ডলফিন ছয় থেকে দশ বছরে প্রজননক্ষম হয় এবং দুই থেকে তিন বছর অন্তর মাত্র একটি করে বাচ্চা জন্ম দেয়।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, ১৯৮০ সাল থেকে অন্তত ৫০০টির বেশি ডলফিন মারা গেছে। বেশিরভাগই মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে, আবার অনেককে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হয়। ডলফিনের মাংস এবং শরীর থেকে প্রাপ্ত তেল মাছ ধরার টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তবে আরও ভয়াবহ দিক হলো—অনেক জেলে আইনগত জটিলতা এড়াতে ডলফিন হত্যার ঘটনা গোপন রাখেন। ভারতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ডলফিন শিকার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও প্রয়োগের ঘাটতি রয়ে গেছে।
এছাড়া নদীতে ক্রমবর্ধমান ক্রুজ পর্যটন পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলেছে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে এখন নিয়মিতভাবে চলাচল করছে বিলাসবহুল জাহাজ। আর এতে ভয় পাচ্ছেন সংরক্ষণবাদীরা।
ভারতের পরিবেশবিদ রবীন্দ্র কুমার সিনহা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ডলফিন শব্দের প্রতি খুব সংবেদনশীল। ক্রুজ চলাচল বাড়তে থাকলে গাঙ্গেয় ডলফিন বিলুপ্তির দিকে যেতে পারে—যেমনটা চীনের ইয়াংজি নদীর বাইজি ডলফিনের সঙ্গে হয়েছিল।
চোখে দেখতে না পারা, ধীর সাঁতারের গতি এবং শব্দভিত্তিক দিকনির্দেশনার ওপর নির্ভরশীলতার কারণে এই ডলফিন প্রজাতিটি প্রায়ই নৌকা বা বড় জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে যায়।
তবে এত প্রতিকূলতার মধ্যেও কিছু আশার খবর রয়েছে। ২০০৯ সালে গাঙ্গেয় ডলফিনকে জাতীয় জলজ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করে ভারত সরকার। এরপর ২০২০ সালে প্রণীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা এবং ২০২৪ সালে স্থাপিত একটি গবেষণা কেন্দ্র ডলফিন সংরক্ষণে ভূমিকা রেখেছে।
রবীন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, হ্যাঁ, আমরা কিছুটা অগ্রগতি করেছি। তবে এখনও অনেক পথ বাকি। এই প্রাণীকে বাঁচাতে আমাদের হাতে সময় খুব কম।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘণ্টা, ৭ এপ্রিল ২০২৫
এসএস/এমজে