ঢাকা: আজকের নেলসন ম্যান্ডেলা গড়ে উঠেছিলেন ছোট বয়স থেকেই। তরুণ বয়স থেকেই দেশের মানুষের মুক্তির কথা ভাবতেন তিনি।
ম্যান্ডেলা যখন ছোট শিশু তখনই থেকেই পরিবারের জ্যেষ্ঠদের কাছে শোনেন শোষণ আর বৈষম্যের বেদনার কথা। অনুপ্রাণিত হয়েছেন পূর্বপুরুষদের নিপীড়নবিরোধী যুদ্ধের গল্প শুনে।
ম্যান্ডেলার ছোট থাকতেই তার বাবা মারা যান। তরুণ বয়সে ম্যান্ডেলার হাতে তুলে দেওয়া হয় মেজেহেকেজাওয়োনির গ্রেট প্লেসের জংইনতাবার অভিভাবকত্ব। কুনু গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শুরু হয় মাদিবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিস এমদিনগানে তার নাম দেন ‘নেলসন’। মাদিবা ম্যান্ডেলার গোত্রীয় নাম।
ক্লার্কবারি বোর্ডিং ইন্সটিটিউট থেকে জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর হেল্ডটাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন দক্ষিণ আফ্রিকানদের ‘টাটা’ (দাদা)। এখান থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ফোর্ট হারের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন। ইউনিভার্সিটি অব সাউদ আফ্রিকা থেকে বিএ ডিগ্রি লাভের পর তিনি ফোর্ট হারে যান।
পড়াশোনা শেষ করে গ্রামে ফিরবেন ম্যান্ডেলা । কিন্তু ম্যান্ডেলাকে মাতৃভূমি মেজেহেকেজাওয়োনির গ্রেট প্লেসে পা রাখতে দেবেন না তৎকালীন রাজা। ফোর্ট হারে ফিরে না গেলে ম্যান্ডেলাকে নানা বেকায়দায় ফেলার হুমকি দেন রাজা। নিরুপায় হয়ে ১৯৪১ জোহানেসবার্গে চলে যান তিনি। সেখানে খনি শ্রমিকের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেব কাজ করতেন।
এরই মধ্যে ওয়াল্টার সিসুলু নামে এক এজেন্টের মাধ্যমে পরিচয় ঘটে আইনজীবী লাজার সিডেলেস্কির সঙ্গে। এলএলবি ডিগ্রী অর্জনের জন্য ইউনির্ভাসিটি অব দ্য উইটওয়াটারস্রান্ডে ভর্তি হন ম্যান্ডেলা। কিন্তু অর্থের অভাবের কারণে বেশি দূরে এগিয়ে যেতে পারেন নি, মধ্য পথে থামতে হয় তাকে। গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন না করে ১৯৪৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন তিনি। ফের ইউনির্ভাসিটি অব লন্ডনে ভর্তি হলেন তিনি। কিন্তু সেখানেও পড়াশোনা সম্পন্ন করতে পারেন নি তিনি। ১৯৮৯ সালের কারাবন্দীত্ব থেকে মুক্তির শেষ মাসে ইউনির্ভাসিটি অব সাউথ আফ্রিকা থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়ান ম্যান্ডেলা। ১৯৪৪ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগ দেন তিনি। তারই উদ্যোগে গঠিত হয় এএনসি যুব লীগ।
বিএ পাসের পর দু বছর আইন বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এরপর শুরু করেন আইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ। ১৯৫২ সালে তিনি ও অলিভার তাম্বো দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য প্রথম আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘ম্যান্ডেলা অ্যান্ড তাম্বো’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫২ সালের শেষ দিকে তাকে প্রথমবারের মতো নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৫৫ সালের ৫ ডিসেম্বর দেশব্যাপী পুলিশের সাড়াশি অভিযানে ১৫৬ জন সরকারবিরোধীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের একজন ছিলেন ম্যান্ডেলা। তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে ১৯৫৬ সালে বিচার শুরু হয়। ১৯৬১ সালের ২৯ মার্চ ম্যান্ডেলাসহ ২৮ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
কৃষ্ণাঙ্গ আইন পাস হওয়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ শার্পভিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে ৬৯ জন নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করে। ওই বছরের ৩১ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম জরুরি অবস্থা জারি ও ৮ এপ্রিল এএনসি ও প্যান আফ্রিকীয় কংগ্রেসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। জরুরি অবস্থায় নেলসন ম্যান্ডেলাসহ ফের হাজারো কৃষ্ণাঙ্গকে গ্রেফতার করে শেতাঙ্গ সরকার।
বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ থেকে মুক্তির পর আত্মগোপনে যান নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৬১ সালের ২৯, ৩০ ও ৩১ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট পালনের পরিকল্পনা করেন। জরুরি অবস্থার কারণে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। ওই বছরের জুন মাসে ম্যান্ডেলাকে সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন সহযোগীরা।
অবৈধভাবে দেশত্যাগ ও গোপনে শ্রমিকদের ধর্মঘটে উসকে দেয়ার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।
দোষীসাব্যস্ত করে তাকে দেয়া হয় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। তাকে রাখা হয় প্রিটোরিয়ার স্থানীয় একটি কারাগারকে।
১৯৬৩ সালের ২৯ মে তাকে রোবেন দ্বীপে স্থানান্তরিত করা হয়। ১২ জুন ফের প্রিটোরিয়ায় আনা হয় নেলসন ম্যান্ডেলাকে। ওই সময় রিভোনিয়া থেকে তার কয়েক কমরেডকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৩ সালের অক্টোবরে নতুন করে নয় সহযোগীসহ ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ এনে রিভোনিয়া বিচার শুরু হয়।
মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়ে ১৯৬৪ সালের ২০ এপ্রিল আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি ঐতিহাসিক বক্তব্য দেন যা তাকে অমরত্ব দিয়েছে।
তিনি বলেন, “আমি সাদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়েছি। আমি কালোদের ওপর আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়েছি।
আমি একটি গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের আর্দশ লালন করি যে সমাজে সব মানুষই শান্তিতে বসবাস ও সমান সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে। এই আদর্শের জন্য আমি বেঁছে থাকতে ও তা বাস্তবায়ন করতে আশাবাদী। কিন্তু যদি প্রয়োজন হয়, এই আদর্শের জন্য মৃত্যুকে বরণ করতে প্রস্তুত আমি। ”
১৯৬৪ সালের ১১ জুন নেলসন ম্যান্ডেলা ও অন্য সাত অভিযুক্তকে-ওয়াল্টার সিসুলু, আহমেদ কাতরাদা, গোভান এমবেকি, রেমন্ড এমহলাবা, ডেনিস গোল্ডবার্গ, এলিয়াস মোতসোলেইদি এবং এন্ড্রু এমলানগেনি-দোষীসাব্যস্ত করে আদালত। পরের দিন তাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। শেতাঙ্গ ডেনিস গোল্ডবার্গকে প্রিটোরিয়ার কারাগারে রেখে বাকিদের পাঠানো হয় রোবেন দ্বীপে।
১৯৬৮ নেলসন ম্যান্ডেলার মা ও ১৯৬৯ সালে তার বড়পুত্র থেম্বি মারা যান। কিন্তু তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি ম্যান্ডেলাকে।
১৯৮২ সালের ৩১ মার্চ রোবেন দ্বীপ থেকে কেপটাউনের পোলসমুর প্রিজনে সিসুলু, এমহলাবা ও এমলানগেনিকে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮৫ সালে প্রোস্টেট সার্জারি করা হয় তার। অসুস্থ থাকার সময় তৎকালীন বিচারবিষয়ক মন্ত্রী ম্যান্ডেলার সঙ্গে দেখা করেন। সরকার ও এএনসির মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নেন ম্যান্ডেলা।
১৯৮৮ সালে টিউবারকিউলোস ধরা পড়লে তাকে ভিক্তর ভার্সটার প্রিজনের কাছে একটি বাড়িতে গৃহবন্দী রাখা হয়। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাকে মুক্তি দেয় শেতাঙ্গ সরকার। এর আগে এএনসির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় সরকার। মুক্তির আগে সরকার কমপক্ষে তিন দফা প্রস্তাব দিয়েছিল শর্তে মেনে মুক্তি পেতে। কিন্তু লোভনীয় সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন তিনি।
সংখ্যালঘু ক্ষমতাসীন শেতাঙ্গদের সঙ্গে আলোচনার শুরু করেন তিনি। ১৯৯১ সালে এএনসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালে বণবার্দবিরোধী আন্দোলনের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এফডব্লিউ দি ক্লার্কের সঙ্গে শান্তিতে নোবেল জয় করেন।
১৯৯৪ সালের নির্বাচনে জয় পেয়ে ইতিহাসে নাম লেখান নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৯৪ সালের ১০ মে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি।
প্রতিশ্রুতিমতো মাত্র এক মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অব্যাহতি নেন তিনি।
এরপর মনোনিবেশ করেন নেলসন ম্যান্ডেলা চিলড্রেন’স ফান্ড। এরপর প্রতিষ্ঠা করেন লেনসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশন ও দ্য ম্যান্ডেলা-রডোস ফাউন্ডেশন।
শেতাঙ্গদের বৈষম্য থেকে মুক্তি আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করায় দক্ষিণ আফ্রিকানদের কাছে ‘টাটা’ (বাবা) নামে পরিচিত নেলসন ম্যান্ডেলা।
বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩