প্রচারের দুনিয়া বড্ড ভুল পথে হাঁটছে আজকাল। কেউ একজন ‘চিলে কান নিয়েছে’ বলামাত্র তার সত্যতা যাচাই না করেই তা সংবাদ হয়ে যাচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যারা জরিপের জোরে ফেলে দিয়েছিল, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পই হয়ে উঠেছেন নায়ক। আর যে হিলারিকে জরিপে-জরিপে প্রায় জিতিয়ে দিয়েছিল বাঘা বাঘা টিভি ও সংবাদ মাধ্যম, সেই হিলারির হয়েছে এক অবিশ্বাস্য, ঐতিহাসিক ভরাডুবি। অবস্থাটা এমন যে, পক্ষপাত দুষ্টতার নগ্ন রূপ মিডিয়াকে করে তুলেছে হাস্যকর।
এসব নিয়ে www.niemanlab.org--এ মার্কিন সাংবাদিক যশুয়া বেনটন (JOSHUA BENTON )লিখেছেন এক নিবন্ধ । তাতে তিনি পরতে পরতে দেখিয়েছেন মিডিয়ার দেউলিয়াত্ব। এই দেউলিয়াত্ব ও ব্যর্থতা আগামীতে যে আরো বাড়বে, প্রকটতর হবে সেকথা বলতেও দ্বিধা করেননি তিনি। সেইসঙ্গে বলেছেন মাস মিডিয়ার আয়ের পথও কমে আসছে, যা আরো কমবে।
৯ নভেম্বর ‘The forces that drove this election’s media failure are likely to get worse’শিরোনামের এই নিবন্ধে যশুয়া বেনটন বিস্তারিত আকারে অনেক কথাই বলেছেন।
নিবন্ধের শুরুতেই যশুয়া বলেছেন, কোনো জনগোষ্ঠির কাছে নিজের সঠিক পরিচয় ও সত্যতা তুলে ধরাই সাংবাদিকতার বড় কাজ। কিন্তু মার্কিন মিডিয়া এবারের নির্বাচনে তার প্রমাণ দিতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর তাতে করে সাংবাদিকতা আসলে এক বাজে কাজ ---একথাই প্রকটভাবে প্রতীয়মান হয়েছে: ‘...and on those terms the American media failed spectacularly this election cycle. That Donald Trump’s victory came as such a surprise — a systemic shock, really — to both journalists and so many who read or watch them is a marker of just how bad a job we did.’’
যশুয়া বলেছেন, বিজনেস মডেল হিসেবে মাস মিডিয়া দিনকে দিন তার আগের অবস্থান হারাচ্ছে, আর ব্যক্তিগত সোশাল ফিডের বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে; যাচ্ছেতাই জিনিসে ছয়লাপ হয়ে যাচ্ছে এসব ফিড। ক্রমপ্রসারমান ব্রহ্মাণ্ডের মতোই ক্রমশ আকার বাড়ছে এসবের। সবদিকে তা ছড়িয়ে পড়ছে। আর তাতে করে সত্য সাংবাদিকতা যাচ্ছে নির্বাসনে।
এইসব ফাঁপা, অন্তসারশূন্য, গুজবনির্ভর, বাস্তবতাহীন, সস্তা ও অনির্ভরযোগ্য অপ-তথ্যের জোয়ারের জন্য যশুয়া প্রথমেই একহাত নিয়েছেন সামাজিক মিডিয়া ফেসবুককে। আর প্রচলিত সংবাদপত্র ও টিভি মিডিয়াও বাদ যায়নি। তার ভাষায়: ‘There’s plenty of blame to go around, but the list of actors has to start with Facebook.’
কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ফেসবুক প্রতিমাসে প্রায় ২০০ কোটি মানুষের কাছে নিজেকে মেলে ধরে। এটা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি বস্তুনিষ্ঠতার দিক থেকে এর ব্যর্থতাও সীমাহীন।
‘আমাদের গণতন্ত্রের অনেক সমস্যাই আছে, তবে ভালো অনেক কিছুই আছে’, যেসবকে ফেসবুক থোড়াই কেয়ার করে। আর তা হচ্ছে সত্যনিষ্ঠা। এদিকটায় ফেসবুকের কোনোই মাথাব্যথা নেই। যশুয়া এমনটাই মনে করেন।
যশুয়ার মতে, ফেসবুক হয়ে উঠেছে ভুল তথ্যের খনি। এর পেছনে শুধু মুনাফালোভী মানসিকতাই কাজ করছে। ফেসবুকে কি গেল না গেল, সেটা গুজব না সত্য তা যাচাই করার কোনো তাগিদই নেই ফেসবুকওয়ালাদের। ফেসবুকে যা কিছু আপলোড হয় নিমেষে তা ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। আর মিডিয়া, সংবাদপত্র ও টিভিওয়ালারা পর্যন্ত সেসব গিলে নেয় টোপের মতো—‘The fake stuff, when it connects with a Facebook user’s preconceived notions or sense of identity, spreads like wildfire. (And it’s a lot cheaper to make than real news.)’’
যশুয়া বেনটন দক্ষিণ লুইজিয়ানার একটি ছোট্ট শহরের বাসিন্দা। প্রসঙ্গক্রমে তিনি একটা আনকোরা বাস্তব নজিরও টেনেছেন তার শহরের স্বয়ং মেয়রের গুজবপ্রীতির প্রমাণ দিয়ে। তিনি মেয়রের নিজস্ব ফেসবুক পেজে অসত্যের ছড়াছড়ি দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে লেখেন: ‘‘The day before the election, I looked at the Facebook page of the current mayor. Among the items he posted there in the final 48 hours of the campaign: Hillary Clinton Calling for Civil War If Trump Is Elected. Pope Francis Shocks World, Endorses Donald Trump for President. Barack Obama Admits He Was Born in Kenya. FBI Agent Who Was Suspected Of Leaking Hillary’s Corruption Is Dead.’’
বুঝুন অবস্থাটা! স্বয়ং মেয়রেরই যখন এই অবস্থা, তখন সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কী আর দোষ!
তিনি আরও লিখেছেন: ‘These are imaginary, made up, frauds. And yet Facebook has built a platform for the active dispersal of these lies — in part because these lies travel really, really well. (The pope’s “endorsement” has over 868,000 Facebook shares. TheSnopes piece noting the story is fake has but 33,000.)’’
এমনকি নিউইয়র্ক টাইমস—এর মতো পত্রিকাও যে অনেক সময় ভাসা-ভাসা তথ্যের ওপর ভর করে চলে সেকথাও বলতে কসুর করেননি যশুয়া। নির্বাচনের আগে The New York Times-এ Jim Rutenberg একটি নিবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বলেন: “the cure for fake journalism is an overwhelming dose of good journalism.”
যশুয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, রুটেনবার্গের কথা সত্য হলে তিনি খুশিই হতেন, কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। একথা বলে নিউইয়র্ক টাইমসের দিকে পরোক্ষে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন যশুয়া।
আরেক বাঘা পত্রিকা দ্য হাফিংটন পোস্টকেও একহাত নিতে ছাড়েননি তিনি: ‘‘The Huffington Post On election morning, The Huffington Post told its readers Clinton had a 98 percent chance of being elected; the Times put it at 85 percent. And let’s not forget all the Here’s-why-Trump-can’t-possibly-win explainers.’’
নির্বাচনকে ঘিরে প্রভাবশালী এই পত্রিকাটির অবস্থান, পক্ষপাতদুষ্ট জরিপ ও সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে অবস্তুনিষ্ঠতাকে এভাবে সমালোচনা করে তিনি। ট্রাম্পের জয় ও তার পক্ষে বিপুল গণরায় সেটাই বলে।
তবে এক্ষেত্রে সংবাদপত্র জগতের ওল্ডটাইম জায়ান্ট The Times ও The Washington Post আর সেইসঙ্গে BuzzFeed and The Daily Beast—এর তুলনামূলক বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার কিছুটা প্রশংসাও করেছেন তিনি। এছাড়া কিছু সম্প্রচারিত সংবাদেরও প্রশংসা ঝরেছে তার কলমে: ‘There were plenty of good broadcast reporters on the beat as well, though what appeared on air left a lot to be desired.) ’’
মোদ্দা কথা, যশুয়া বলতে চান খারাপ, খণ্ডিত ও অপ-সাংবাদিকতার ভিড়ে এখন ভালো সাংবাদিকতা হারিয়ে যাচ্ছে বা আড়ালে পড়ে যাচ্ছে।
যশুয়া পেসবুকে অপ-তথ্য, অপ-সংবাদ ও তথ্য আকারে প্রকাশিত গুজবকে রাশ টানার জন্য মার্ক জুকারবার্গ ও তার টিমকে একটা পরামর্শ দিয়েছেন। তা হচ্ছে, অন্তত একটা টিম গঠন করা যে টিম কোনটা গুজব আর কোনটা সত্য তা যাচাই করবে। নিদেন পক্ষে সবচে বাজে আর নোংরা গসিপগুলোকে বাদ দিয়ে হলেও ফেসবুককে কিছুটা হলেও জঞ্জালমুক্ত করবে-‘I don’t know what the right solution would be — but I know that getting Mark Zuckerberg to care about the problem is absolutely key to the health of our information ecosystem.’
প্রচলিত প্রিন্ট ও অন্যসব মিডিয়ার প্রতিও তার পরামর্শ একই। এক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত কিছু সংবাদপত্র ও বুলেটিন আশ্চর্যজনকভাবে সত্যনিষ্ঠ সংবাদ ও তথ্য প্রচারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বলে দাবি করেন যশুয়া। ছোট আকারের হলেও এরা জাতীয় পর্যায়ের বাঘা বাঘা মিডিয়ার সামনে রোল মডেল হতে পারে বলে তার বিশ্বাস।
যশুয়া বেনটন নিবন্ধের শেষদিকে লিখেছেন:
‘‘বলা হয়ে থাকে, আমরা সেই রকম মিডিয়াই পেয়েছি, যে রকম মিডিয়ার যোগ্য আমরা। আমরা যে ধরনের সাংবাদিকতা দেখতে পাই তা মূলত বিরাজমান ব্যবসা-কাঠামো ও ভোক্তার রুচি-পছন্দেরই প্রতিফলন। জনমত গড়ে তোলার জন্য মুষ্ঠিমেয় এলিট গোষ্ঠির সিদ্ধান্তের ফল নয় মোটেই।
সংবাদের জন্য যদি আমরা একটি অধিকতর ভালো পরিবেশ গড়ে তুলতে চাই, তাহলে এইসব বিষয় নিয়ে বৃহত্তর পটভূমিতে ভাবতে হবে। কেবল একটা ‘নির্বাচনী রাত’কে নিয়ে মাথা ঘামালেই চলবে না। আর সেটা ভাবতে হবে সাংবাদিক, পাঠক, টেক-কোম্পানি সবাইকেই। তাহলেই বেরিয়ে আসছে সমাধানসূত্র। ’’
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা কি আদৌ হবে? বেড়ালের গলায় ঘন্টাটি বাঁধবার কাজ আদৌ কি হবে?
বাংলাদেশ সময়: ২২১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৬
জেএম