ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সড়ক দুর্ঘটনা তদন্তে বেরিয়ে এলো ২ হত্যাকাণ্ড

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৩
সড়ক দুর্ঘটনা তদন্তে বেরিয়ে এলো ২ হত্যাকাণ্ড শাহন শাহ আলম বিপ্লব ও মো. মনির হোসেন: ফাইল ফটো

ঢাকা: ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদী এলাকায় মাইক্রোবাসের ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। এ ঘটনাকে সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখ করে মাইক্রোবাস মালিককে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্রও দেয় হাইওয়ে পুলিশ।

তবে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসে ঘটনার আসল রহস্য। পরিকল্পিতভাবে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতেই মাইক্রোবাস দিয়ে ধাক্কা দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহীদের হত্যা করা হয়।

পিবিআই জানায়, ২০২১ সালের ১২ আগস্ট সন্ধ্যায় নরসিংদীর শিবপুর থানা এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী শাহন শাহ আলম বিপ্লব (৩৪) ও মো. মনির হোসেন (৩৪) নিহত হন।

এ ঘটনায় সড়ক পরিবহন আইনে দায়েরকৃত একটি মামলায় মাইক্রোবাস মালিক মাসুম মিয়াকে (৪১) অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় হাইওয়ে পুলিশ। এ তদন্তে নিহত বিপ্লবের ভাই সোহাগ মিয়া নারাজি দেন এবং আদালতে আরেকটি সিআর মামলা করেন।

নারাজির প্রেক্ষিতে হাইওয়ে পুলিশের মামলাটির সঙ্গে সিআর মামলাটিকে যুক্ত করে অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পিবিআই নরসিংদী জেলাকে। পরে পিবিআইয়ের তদন্তে হত্যাকাণ্ডের রহস্য বেরিয়ে আসে।

জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মোট ৯ জন। এদের মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়, যাদের মধ্যে তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

গ্রেফতার চারজন হলেন- মো. মাসুম মিয়া, সোহাগ মিয়া, মাসুদ মিয়া ও মামুন মিয়া।

সড়ক দুর্ঘটনার মামলার তদন্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেরিয়ে আসা ই ঘটনায় আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দেবে বলে জানিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিহত শাহান শাহ আলম বিপ্লব এলাকায় একাধিক হত্যা মামলার আসামি ও মনির হোসেন তার বডিগার্ড। বিপ্লব এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করলেও তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পেত না।

এক সময় বিপ্লবের সঙ্গে ডিশ ব্যবসা করা মামুন মিয়াই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ইতোপূর্বে দুইবার হত্যাচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয় মামুন। সবশেষে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতে মাইক্রোবাস চাপা দিয়ে হত্যা করা হয় বিপ্লব ও তার সঙ্গী মনিরকে।

মামলার তদন্তের প্রেক্ষিতে পিবিআই জানায়, ২০১৯ সালে দুলাল গাজীকে রায়পুরা লোচনপুর বাজারে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। যার প্রধান আসামি ছিলেন বিপ্লব। ঘটনাটি বাজারের মধ্যে প্রকাশ্যে সংঘটিত হলেও বিপ্লবের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। বিপ্লবের বিরুদ্ধে ৪টি হত্যাসহ ১০টি মামলা ও ১১টি গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে।

কিন্তু বিপ্লব ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিলেন এবং তার ভয়ে কেউ সাক্ষী দিতে চায়নি। এমন পরিস্থিতিতে দুলাল গাজী হত্যা মামলায় পিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হন বিপ্লব।

বিপ্লব জেল থেকে জামিনে বের হয়ে ওই মামলায় সাক্ষীদের দুইজন জুয়েল (২২) ও নাঈমকে (২৩) এলাকায় ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এমনকি পিবিআইয়ের যে কর্মকর্তা বিপ্লবকে গ্রেফতার করেছিল তার বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ করেন বিপ্লব। পরে অভিযোগটি জেলা পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেয় পুলিশ সদর দপ্তর।

বিপ্লব ও তার সঙ্গীদের এমন কর্মকাণ্ডে এলাকার অনেকে ক্ষিপ্ত হয়। এর মধ্যে এক সময় বিপ্লবের সঙ্গে ডিশের ব্যবসা করা মামুন মিয়া তার সহযোগীদের নিয়ে বিপ্লবকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন।

গ্রেফতারদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পিবিআই জানায়, পরপর তিনবার বিপ্লবকে হত্যার চেষ্টা করে তৃতীয়বার সফল হয় তারা। সর্বশেষ ঘটনার দিন প্রথমে লোচনপুর থেকে তারা দলবদ্ধভাবে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ নরসিংদী রওনা করে। পথে বারৈচা থেকে কালো মাইক্রোবাসটি সংগ্রহ করে।

তথ্য সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য মোটরসাইকেলে করে সোহাগ ও ফয়সাল নরসিংদীতে আসেন। অন্যান্যরা নরসিংদী শহরের ভেলানগর জেলখানা এলাকায় অবস্থান করতে থাকেন। সোহাগ ও ফয়সাল ভিকটিম বিপ্লবের সার্বক্ষণিক মুভমেন্ট ফলো করে জানাতে থাকেন।

পিবিআই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা বিপ্লবের অভিযোগটির তদন্তে সেদিন বিপ্লবকে জেলা পুলিশ সুপারের (এসপি) কার্যালয়ে ডাকা হয়। এসপি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে বিপ্লব মনিরের মোটরসাইকেলে উঠে বসেন।

বিপ্লব ও মনির মোটরসাইকেলে করে হাইওয়েতে উঠলে সোহাগ তাৎক্ষণিক তথ্য জানিয়ে দিলে হত্যার উদ্দেশে অবস্থানরত আসামিরা ভিকটিম দুইজনকে অনুসরণ করতে থাকেন। প্রথমে একবার পেছন থেকে আঘাত করে ব্যর্থ হয়ে সামনে গিয়ে আবার অবস্থান করে। একপর্যায়ে বিপ্লবের মোটরসাইকেলটি তাদের মাইক্রোবাস ক্রস করার সময় পেছন থেকে পরিকল্পিতভাবে ধাক্কা দেয় এবং ঘটনাস্থলেই বিপ্লব ও মনির নিহত হয়।

এ সময় মাইক্রোবাসটি তাদের ধারণার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ঘটনাস্থলে মাইক্রোবাসটি রেখেই পালিয়ে যায় তারা।

এ প্রসঙ্গে পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৯ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি পাঁচজনকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের পেছনে অর্থদাতা হিসেবে ওমর ফারুক মোল্লা নামে এক প্রবাসীর নাম উঠে এসেছে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি অনুসন্ধান চলছে। আগামী সপ্তাহে জড়িত নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হবে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার মামলাটি তদন্তে নেমে পিবিআই জানতে পারে কথিত দুর্ঘটনার আগে মাইক্রোবাসে যাত্রী ছিলো। কিন্তু দুর্ঘটনার পর যাত্রীদের কাউকে পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনা হলে চালক পালিয়ে গেলেও যাত্রীদের পালানোর কথা নয়। যেটি হাইওয়ে পুলিশের প্রথম তদন্তে নজরে আসেনি।

বিষয়টি খটকা লাগলে এর পেছনের কারণ অনুসন্ধানে নামে পিবিআই। এরপর জানা যায়, ঘটনাটি মহাসড়কে ঘটলেও এর পেছনে ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে।

তদন্তের এক পর্যায়ে প্রথমে মাইক্রোবাস মালিক মাসুম মিয়াকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যে বাকি তিনজন মামুন, সোহাগ ও মাসুদকে গ্রেফতার করা হয়। যে তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২৩
পিএম/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।