ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সমাজভিত্তিক মৎস্যচাষের পুকুর আ.লীগ নেতাদের দখলে!

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৭ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২৪
সমাজভিত্তিক মৎস্যচাষের পুকুর আ.লীগ নেতাদের দখলে! ড্যাবরা পুকুর

সিরাজগঞ্জ: সুফলভোগীদের পরিবর্তে নিমগাছী সমাজভিত্তিক মৎস্যচাষ প্রকল্পের বেশিরভাগ পুকুরই এখন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের  রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।  

অভিযোগ রয়েছে, এসব পুকুর সাব-লিজ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন তারা।

নীতিমালা অনুযায়ী, খাস পুকুরের শতভাগ অধিকার পাশে বসবাসরত হতদরিদ্র সুফলভোগীদের দেওয়ার কথা থাকলেও বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদের। ভয়ে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছেন না সুফলভোগীরা।  

সরেজমিন অনুসন্ধানে প্রকল্প এলাকা সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার একাধিক পুকুরের ক্ষেত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে এসব অনিয়ম বন্ধে প্রকল্প কর্মকর্তারা তাদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন।  

নিমগাছী সমাজভিত্তিক মৎস্যচাষ প্রকল্পের কার্যালয় সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ৫১৫, রায়গঞ্জে ১০৪, পাবনার চাটমোহরে ১০০ ও ভাঙ্গুড়ায় ৬০টি মিলে মোট ৭৭৯টি সরকারি পুকুর রয়েছে। এসব পুকুরের মোট আয়তন ৬৭৪ দশমিক ৭৬ হেক্টর। এসব মাছ উৎপাদনের জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে ২০২৩ সালে তৃতীয়বারের মতো পুকুরগুলো হস্তান্তর করে ভূমি মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০১১ সালে ছয় বছর মেয়াদের সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে পুকুরগুলো নিয়েছিল মৎস্য মন্ত্রণালয়। সেই সময় “নিমগাছী সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা” নামে একটি নীতিমালা প্রণয়ন এবং ২০১৪ সালের জুন মাসে পাঁচ বছর মেয়াদের নিমগাছী সমাজভিত্তিক মৎস্যচাষ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। নীতিমালায় পুকুরপাড়ের বেকার, যুবক, যুবমহিলা, মৎস্যজীবী, বিধবা ও হতদরিদ্রদের সুফলভোগী সদস্য করে সমিতির মাধ্যমে মাছচাষের কথা বলা হয়। এ ক্ষেত্রে সুফলভোগী সদস্যদের শতভাগ অধিকার দেওয়া হয়।  

রায়গঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৭ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ শেষ হলে সেটি আবার ছয় বছরের জন্য নবায়ন করা হয়। এদিকে ২০১৯ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের চুক্তির মেয়াদ থাকায় আবার প্রকল্পটি চালুর সিদ্ধান্ত নেয় মৎস্য বিভাগ। চার বছর চেষ্টার পর ২০২৩ সালের জুন মাসে নতুন করে শুরু হয় প্রকল্পটি।  

প্রকল্প এলাকার পুকুরগুলো ঘুরে অবৈধভাবে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাব-লিজ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ জানা যায়।

সোনাখাড়া ইউনিয়নের বন্দিহার এলাকায় ৭৯ বিঘা আয়তনের রুদ্রদিঘির সুফলভোগী সদস্য ১৩৮ জন। প্রকল্পের শুরুর দিকে বেশ কয়েক বছর সুফলভোগীরা মাছ চাষ করে উপার্জিত টাকা নিজেরা বণ্টন করে নিতেন। কিন্তু চার বছর ধরে এ পুকুরটি সাব-লিজ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সুফলভোগী দলের সভাপতি-সম্পাদকসহ কমিটির কয়েকজনের বিরুদ্ধে।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুফলভোগীরা বলেন, পুকুরটা আমাদের নামে সরকার লিজ দেয়। সমিতির নামেই ডিসিআর কাটা হলেও সভাপতি এটিকে সাব-লিজ দিয়েছেন। এবার ফরিদ নামে একজন লিজ নিয়েছেন। কত টাকায় লিজ দেওয়া হয়েছে, তা আমরা জানি না। সদস্যদের নিয়ে মিটিংও করা হয় না। শোনা যাচ্ছে, ৩০ লাখ টাকায় লিজ দেওয়া হয়েছে। সদস্যদের ছয়/সাত হাজার টাকা করে দিয়েছে। কিছু বলতে গেলে সদস্য পদ থেকে বাদ দেওয়ার হুমকি দেন। আব্দুল জব্বার পুকুরপারের বাসিন্দা না হয়েও এমপি ডা. আব্দুল আজিজের ডিও লেটারে সভাপতি হয়েছেন। তার পরিবারের পাঁচ/ছয়জন সদস্য রয়েছেন।  

এদিকে এ পুকুর সাব-লিজ দেওয়ার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সুফলভোগী সদস্য রামেন্দ্রনাথ মাহাতো। অভিযোগ দেওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন তারা।  

তারা বলেন, আমরা বেশ কয়েক বছর চাষাবাদ করেছি। গত চার বছর ধরে সেটা করতে দিচ্ছেন না স্থানীয় নেতারা।  

এ বিষয়ে ওই পুকুরের সভাপতি আব্দুল জব্বার পুকুর সাব-লিজ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমরা মিটিং করে রেজুলেশন করি। সামনা-সামনি আসেন কথা হবে।  

পার্শ্ববর্তী গোতিথা গ্রামের ড্যাবরা পুকুর ও আন্ধিয়া পুকুরের সুফলভোগীরাও একই কথা বলেন। ড্যাবরা পুকুরপারের এক নারী সুফলভোগী বলেন, আমরা আগে পুকুরে মাছচাষ করেছি। এখন কার কাছে কত টাকায় সাব-লিজ দিয়েছে জানি না। সদস্যদের পাঁচ/ছয় হাজার করে টাকা দেয় বছরে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রিপন এ সাব-লিজ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত।  

এ পুকুরের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন বলেন, আগে পুকুর লিজ দেওয়া হয়েছিল। অফিসাররা নিষেধ করায় এ বছর কোনো লিজ দেওয়া হয়নি।  

তবে পুকুরের কয়েকজন সুফলভোগী জানান, এ বছর নতুন করে ১৮ লাখ টাকায় সাব-লিজ দিয়ে ৪৪ সুফলভোগীকে নয় হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকা নেতারা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছেন।  

সুরপাই পুকুর মৎস্যজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় কোনো সুফলভোগী সদস্য এখন আর পুকুরে মাছচাষ করেন না। সব লিজ দেওয়া হয়। আগে নিজেরা চাষ করে ২০/৩০ হাজার করে টাকা বছরে সুফলভোগীরা পেয়েছেন। এখন বছরে ছয়/সাত হাজার করে টাকা দেওয়া হচ্ছে। কত টাকায় লিজ দেয় তাও জানি না।  

৭৩ বিঘার জলাশয় ধামাইনগর ইউনিয়নের ক্ষিরিতলা গ্রামের প্রতাপদিঘির সুফলভোগী রাজু বলেন, এ পুকুরের সুফলভোগী সদস্য সংখ্যা ১৪৫ জন। গত বছর নিমগাছী বাজারের রফিকুল উকিল নামে এক ব্যক্তিকে সাব-লিজ দেওয়া হয়। সদস্যদের মাত্র দুই হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছিল। এবার এখনো টাকা দেওয়া হয়নি। লিজ দেওয়ার বিষয়ে কাউকে কিছু জানানো হয় না।  

অপর সুফলভোগী মহিদুল বলেন, কমিটির লোকজন সাব-লিজ দিয়েছে।  

কাতলাদিঘির সুফলভোগী আনোয়ার বলেন, এলাকার সব পুকুরই সাব-লিজ সিস্টেমে চলছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফেরদৌস আলম তালেব এ পুকুর লিজ নিয়েছেন।  

কাতলাদিঘির সভাপতি মাসুম সাবলিজ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আপনার সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে কথা বলব।  

অপরদিকে যোগী পুকুর সাব-লিজ নিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শরিফুল ইসলাম ঝন্টু।  

তাড়াশের উলিপুর দিঘি এলাকার শাহজাহান, জিয়াউর রহমান ও ছানোয়ার হোসেন বলেন, পুকুরপাড়ে বাড়ি এবং দরিদ্র হলেও আমাদের সদস্য করা হয়নি।  

ওই পুকুরের সুফলভোগী সদস্য মায়া খাতুন ও মনজিল বলেন, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইকবাল হাসান রুবেল পুকুরটি সাব-লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছেন।

তাড়াশ ছাত্রলীগের সভাপতি ইকবাল হাসান রুবেল বলেন, দুই বছর ধরে আমি উলিপুর দিঘি সাব-লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছি। এবার ১৪ লাখ টাকায় নিয়েছি। আমার সঙ্গে আরও দুজন পার্টনার রয়েছেন।  

মাধাইনগর ইউনিয়নের ভিকমপুর গ্রামের বড়ঘোনার পুকুরের সুফলভোগী জহুরুল, আক্তার ও রশিদ বলেন, পুকুরটি সাব-লিজ দিয়েছেন সমিতির সভাপতি ও ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম শান্ত। স্থানীয় আব্দুল হাকিমসহ আরও দুজন পুকুরটি সাব-লিজে মাছ চাষ করছেন।  

হাজেরা খাতুন নামে এক বিধবা বলেন, আমি ভূমিহীন বিধবা, আমার ছেলে নেই। তারপরও আমাকে সদস্য করা হয়নি।  

মাধাইনগর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম শান্ত পুকুর সাব-লিজের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, পুকুরে আমরাই মাছচাষ করছি। আপনি দেখা করেন, বিস্তারিত বলব।  

একই চিত্র রায়গঞ্জের সোনাখাড়া ইউনিয়নের শিতলাই বিল, কাড়ালিয়া পুকুর, ঘোড়ামারা, তেতুলিয়া, ধামাইনগর ইউনিয়নের যোগী পুকুর, মায়া পুকুর, তাড়াশের মাধাইনগর, দেশীগ্রাম, তালম, বারুহাস ও নওগাঁ ইউনিয়নের অধিকাংশ পুকুরেরই।  

এসব পুকুরপারের সুফলভোগীরা জানান, সবগুলো পুকুরই সাব-লিজ নিয়ে প্রভাবশালী নেতারা চাষ করছেন। ফলে সুফলভোগী সদস্যরা চাষ করতে পারছেন না। সমিতির সভাপতি-সেক্রেটারির যোগসাজশে মোটা অঙ্কের টাকায় তারা সাব-লিজ নিচ্ছেন। সুফলভোগী সদস্যদের নামমাত্র টাকায় দিয়ে সাবলিজের অধিকাংশ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ প্রভাবশালীরা ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন।  

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বে) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, যারা একটু চালাক ও প্রভাবশালী, তারা পুকুরগুলো নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে চাষ করতে চান। প্রতিটি পুকুর মনিটর করার মতো জনবল আমাদের নেই।  প্রথম দিকে পন্ড অ্যাটেন্ডডেন্ট ছিল ৫৪ জন। এখন ওই পদই বিলুপ্ত হয়েছে। এখানে যারা আছি, সবাই আমরা অতিরিক্ত দায়িত্বে। তাছাড়া প্রকল্পের কাজ শুধু পুকুর সংস্কার, মাছচাষের উপকরণ সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া। সুফলভোগী সদস্য নির্বাচন বা বাতিল করে উপজেলা সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা কমিটি। যার সভাপতি ইউএনও। ওই কমিটি শক্তিশালী হলেই অনিয়ম প্রতিরোধ করা সম্ভব।  

রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ওসি) ও উপজেলা সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নাহিদ হাসান খান বলেন, সাব-লিজের বিষয়টি আমি নিজেও দেখেছি। আমরা যখন জিজ্ঞেস করি, সাব-লিজ কেন দিয়েছেন, তখন আর কেউ কথা বলে না। সাব-লিজের লিখিত কোনো চুক্তি থাকে না, ফলে আমরা তাদের খুঁজেও পাই না।  

তিনি বলেন, সাব-লিজ দেওয়া বেইআইনি। আমরা চাই, নীতিমালা অনুযায়ী এটা পরিচালিত হোক। প্রকৃত দরিদ্র সুফলভোগীরাই চাষাবাদ করুক। কেউ কখনো লিখিত অভিযোগ নিয়ে এলে, সে বিষয় আমরা দেখি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপকারভোগীরা অভিযোগ দেন না। আমরা বিষয়টি আবার দেখব, যদি কোথাও সাব-লিজ দেওয়া হয়, আমরা সেই কমিটি প্রয়োজনে বাতিল করে দেব।

এদিকে বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান জেলা প্রশাসক মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। জেলা মৎস্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হলেও এ বিষয়ে তিনি তেমন কিছুই জানেন না বলে জানান। তিনি বলেন, পুকুরগুলো আমরা মৎস্য বিভাগকে হস্তান্তর করি। তারাই এটা ভালো বলতে পারবে।  

স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) অধ্যাপক ডা. আব্দুল আজিজ বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাদের এভাবে পুকুর নেওয়ার কথা নয়। এক সময় সমাজে যারা আধিপত্য বিস্তার করত, তারাই পুকুরগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। আমরা আসার পর বলেছি, সুফলভোগীদের চাষ করতে দিতে হবে। জয়সাগর, প্রতাপদিঘির মতো পুকুর প্রভাবশালীরা খেত আগে, আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সেগুলো সুফলভোগীদের হাতে তুলে দিয়েছি।

তিনি বলেন, দুই/এক বছরের মধ্যে আমি কাউকে সভাপতি হওয়ার জন্য ডিও লেটার দেইনি। তবে কয়েক বছর আগে একটি পুকুরে দুটি গ্রুপ ছিল। এটা সমাধানের জন্য আলোচনা করে হয়তো ডিও লেটার দেওয়া হয়েছিল।  

বাংলাদেশ সময়: ১২১৭ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২৪

এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।