বার্ন ইনস্টিটিউটজুড়ে হৃদয়বিদারক কান্নার রোল। বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ শরীর আর ছেঁড়া স্বপ্নগুলো একত্র হয়ে যেন এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির ক্যানভাস এঁকে দিয়েছে।
সোমবার (২১ জুলাই) শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এসব হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায়। এই ইনস্টিটিউট আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা, অভিজ্ঞ চিকিৎসক এবং জ্বলন্ত জীবন বাঁচানোর নিরলস প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই স্থানে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে পুড়ে যাওয়া কোমলমতি শিশু এসে পৌঁছায়, যখন তাদের অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ বাতাসে মিশে যায়—তখন চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে যায়, হিম হয়ে আসে হৃদয়।
দগ্ধ স্বজনদের আর্তচিৎকার নিস্তব্ধ দেয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে ছোট ছোট হাত-পা, যাদের এখনও ঠিকমতো জীবন বোঝার সুযোগও হয়নি। হাসপাতালের করিডোরে অশ্রুসিক্ত মুখগুলো যেন প্রশ্ন করে—‘কেন?’
শিশুদের শরীরে পুড়ে যাওয়া চামড়ার গন্ধ, আর সঙ্গে অভিভাবকদের ভেঙে পড়া আহাজারি—এই তিনটি মিলে গড়ে তোলে এক অনুচ্চারিত শোকগাথা। কেউ হারিয়ে ফেলেছেন তার সন্তান, কেউবা নিজের ছোট ভাইটিকে আর কখনো জড়িয়ে ধরতে পারবেন না।
জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দগ্ধ ছোট্ট শিশুগুলোর এই যুদ্ধ কেবল একটি দুর্ঘটনার পরিণতি নয়, বরং আমাদের অসচেতনতা, অব্যবস্থা ও অবহেলার নির্মম প্রতিচ্ছবি। এই কান্না যেন আমাদের চোখ খুলে দেয়, আমাদের জাগিয়ে তোলে—যেন এমন মৃত্যুর মিছিল আর দেখতে না হয়।
হাসপাতালে চোখের সামনে প্রিয়জনকে ছারখার হতে দেখে স্বজনেরা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না। বার্ন ইনস্টিটিউটের করিডোরজুড়ে শুধু আহাজারি, বুকফাটা কান্না— ‘ও মা... উঠো, একবার চোখ খুলো/ও ভাই, আমাকে ছেড়ে যেও না!’
স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতালের দেয়ালগুলো পর্যন্ত যেন ভারী হয়ে উঠেছে কান্নার শব্দে। চিকিৎসকদের নিরব মুখ, দগ্ধ মুখগুলোর বাঁচার আকুতি, আর স্বজনদের ভাঙা আর্তনাদ—সব মিলিয়ে মৃত্যু আর জীবনের হাহাকার যেন স্পষ্টভাবে ছুঁয়ে যায় হৃদয়কে।
এই কেবল একটা দুর্ঘটনা নয়—এ একসাথে বহু হৃদয়ের ভাঙচুর, বহু পরিবারের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া।
তেমনি ইনস্টিটিউটের এক কোণে আর্তনাদ করে এক বাবা বলছিলেন, ‘ক্লাস শেষ হলেও বৃত্তির কোচিংয়ের জন্য স্কুলে থেকে যায় আমার প্রাণপাখি তানভীর। বিমান বিধ্বস্তে প্রাণ হারিয়েছে সে। ’এরকমই বার্ন ইনস্টিটিউটজুড়ে কোণে কোণে স্বজনদের আহাজারি আর আহাজারি।
এদিকে উত্তরায় যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের বিষয়ে রাত ৮টার দিকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান জানান, রাজধানীর সাতটি হাসপাতালে এই ঘটনায় ৮৮ জন ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বার্ন ইনস্টিটিউট ও সিএমএইচে।
বার্ন ইনস্টিটিউটে মোট ৪৪ জন ভর্তি রয়েছেন। এখানেই মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। আইসিইউতে আছেন ৯ জন। সিএমএইচে ভর্তি রয়েছেন ২৫ জন। তিনি বলেন, ‘তাদের চিকিৎসার জন্য যাবতীয় সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ’
হতাহতদের দেখতে হাসপাতালে আসা মানুষজন ও নেতাকর্মীদের নিরুৎসাহিত করে তিনি বলেন, ‘এই রোগীদের ইনফেকশনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি থাকে। এজন্য কেউ যেন হাসপাতালে অযথা ভিড় না করেন। ’
এদিকে বিকেলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে জানানো হয়, রাজধানীর উত্তরায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ২০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৭১ জন।
এদিকে দুপুরের দিকে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে প্রশিক্ষণ বিমান বিস্ফোরণের সংবাদে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দগ্ধ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন। কেউ আসেন রক্ত দিতে, কেউ প্রিয়জনের খোঁজে।
তাদের নিয়ন্ত্রণে বেসরকারিভাবে ভলান্টিয়ারদের পাশাপাশি একপর্যায়ে সেনাবাহিনীকেও বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রবেশপথে অতিরিক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে দেখা যায়।
এজেডএস/আরএইচ