মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সেপটিক ট্যাংকে পড়ে গিয়ে চার তরুণের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন তুলতে গিয়ে শুরু হয় এ দুর্ঘটনা।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের সন্তান রানা নায়েক (১৭) সম্প্রতি একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন কিনে আনেন। বুধবার রাতে তার বড় ভাই শ্রাবণ নায়েক (১৯) সেটি হাতে নেওয়ার পরপরই অসাবধানতাবশত বাড়ির সেপটিক ট্যাংকে পড়ে যায়। শ্রাবণ সেটি তোলার জন্য সেখানে নেমে পড়েন এবং জ্ঞান হারান।
বড় ভাইকে উদ্ধার করতে ছোট ভাই রানা নায়েকও সেপটিক ট্যাংকে নামেন এবং তিনিও একইভাবে জ্ঞান হারান। পরে তাদের উদ্ধার করতে যান স্থানীয় দুই তরুণ— কৃষ্ণ রবিদাস (২০) ও নিপেন ফুলমালি (২৭)। তারাও বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে অচেতন হয়ে পড়েন।
পরে আশপাশের লোকজনের চিৎকারে ছুটে আসেন আরও অনেকে। রবি বুনার্জী নামে এক যুবক উদ্ধার কাজে এগিয়ে গেলে তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় যুবক সঞ্জয় ভূমিজ ও জাস্টিন মিলে রবি বুনার্জীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
গুরুতর অবস্থায় অচেতন ৪ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) বিকেলে সরেজমিন শ্রীমঙ্গল উপজেলার সীমান্ত এলাকা হরিণছড়া চা বাগানের উত্তর লাইনে গিয়ে নানাজনের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্যগুলো পাওয়া যায়।
নিহতদের মধ্যে শ্রাবণ নায়েক ছিলেন চা বাগানের স্থায়ী শ্রমিক এবং তার স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিহত কৃষ্ণ রবিদাস টমটম চালিয়ে পরিবারের জীবিকা চালাতেন। তার মা-বাবা দারিদ্র্যপীড়িত জীবনে একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। নিহত নিপেন ফুলমালি ছিলেন তার পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও ভাইবোনদের নিয়ে অভাবী সংসারে ভরসা ছিলেন তিনি।
নিহত শ্রাবণ ও রানার বাবা উদয় নায়েক ও মা রিনা নায়েক। দুই ছেলে হারিয়ে রিনা আর্তনাদ করে বলছিলেন, আমার দুই ছেলে একসাথে চলে গেলো! ছোট ছেলেটাকে নিয়ে কি করবো? কার কাছে যাবো?
নিহত কৃষ্ণ রবিদাসের মা দেয়ন্তি রবিদাস ছেলে হারানোর দুঃসহ বেদনায় কিছুই বলতে পারছিলেন না। কৃষ্ণ রবিদাসের পিতা জহরলাল রবিদাস বলেন, ওই দুই বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার বাচ্চাটাও আর নাই। আমার ৩ ছেলের মধ্যে কৃষ্ণ সবার ছোট ছিল। সে টমটম চালিয়ে সংসারের আয়রোজগার করতো। আমার গতি এখন কী হবে?
নিহত নিপেন ফুলমালির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মা কামিনী ফুলমালি, স্ত্রী সমিতা ফুলমালি, ৭ বছরের মেয়ে সুইটি এবং ৩ বছরের মেয়ে আলপনাকে নিয়ে উঠানে বসে লাশের অপেক্ষা করছেন। পাশেই উঠানজুড়ে রয়েছে এলাকাবাসীসহ নিপেনের দুই বোন বিনা ফুলমালি ও রিনা ফুলমালি এবং তিন ভাই রাজু, আপন ও দুলাল। ততক্ষণে বাঁধা হয়ে গেছে খাটলা (মৃতদেহ বহনের জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি মাচা)।
ঘটনার পর চা বাগানে শোকের ছায়া নেমে আসে। এলাকাবাসীরা জানান, সবচেয়ে হৃদয়বিদারক হলো আপন দুই ভাইয়ের একসঙ্গে মৃত্যুর ঘটনা। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বাংলানিউজকে বলেন, এই ঘটনা চা শ্রমিক সমাজের জন্য অত্যন্ত মর্মান্তিক। নিহত পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা আমরা করব।
বিবিবি/এমজে