ফেনী: দেশ যখন স্বৈরাচার মুক্তির দ্বারপ্রান্তে, ঠিক আগের দিন ফেনীর মহিপালে ঘটে যায় ভয়াবহ এক গণহত্যার ঘটনা। ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মধ্যে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হয় পৈশাচিক গুলিবর্ষণ।
বিগত ৪ আগস্ট, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ফেনীর মহিপাল উড়ালসেতুর নিচে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে ফুলগাজীর ইশতিয়াক আহম্মেদ শ্রাবণ, দাগনভূঞার সারওয়ার জাহান মাসুদ, সোনাগাজীর মাহবুবুল হাসান মাসুম, জাকির হোসেন শাকিব, ফেনী সদরের সাইদুল ইসলাম, ওয়াকিল আহম্মেদ শিহাব, পৌর এলাকার মোহাম্মদ সবুজসহ মোট ৮ জনকে।
এ সময় আরও দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাচেষ্টা চালানো হয়। আহতদের মধ্যে ছিলেন দাগনভূঞার তাজিম উদ্দিন, নাসির উদ্দীন, ফেনী সদরের মহিউদ্দিন, আবু জাফর, বাহার মিয়া, আবদুর রব, জগলু মিয়া রিয়াজ, সোনাগাজীর বোরহান উদ্দিন, আফসার হোসাইন, সাইদুল রহমান, আসিফুল ইসলাম আহাদ, জামশেদুল আলম, এনামুল হক, ছাগলনাইয়ার ফরহাদ হোসেন এবং কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের আবদুল হান্নানসহ অনেকে।
সেদিন মুহুর্মুহু গুলিতে পুরো মহিপাল এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আহতদের দ্রুত ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তৈরি হয় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। জরুরি বিভাগ রক্তে সয়লাব হয়ে যায়। সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. তরিকুজ্জামান বলেন, আমরা ডিউটিতে ছিলাম। হঠাৎ একের পর এক গুলিবিদ্ধ রোগী আসতে থাকে। ইমার্জেন্সিতে শুধু রক্ত আর রক্ত। পা রাখার জায়গা ছিল না।
মেডিকেল অফিসার নাজমুল হক সাম্মিও বলেন, ৪ আগস্ট ছিল পীড়াদায়ক এক দিন। দুপুর থেকে একের পর এক গুরুতর আহত রোগী আসতে থাকে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আমরা হিমশিম খেয়ে যাই। সেবার জন্য সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
ফেনী জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২২টি মামলা হয়েছে—এর মধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা। এসব মামলায় ২ হাজার ১৯৯ জন এজাহারনামীয় এবং প্রায় ৪ হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে। বেশিরভাগ মামলায় ফেনী-২ আসনের সাবেক সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারীকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ নাসিম, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাসুদ উদ্দিন, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও একাধিক মামলায় আসামি করা হয়েছে।
আরও উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন—ফেনী সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল, পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী, ছাগলনাইয়ার সাবেক চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল, দাগনভূঞার সাবেক চেয়ারম্যান ও যুবলীগ সভাপতি দিদারুল কবির রতন, পরশুরামের সাবেক মেয়র নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সাজেল, সোনাগাজীর সাবেক চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন, যুবলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম পিটু ও জিয়া উদ্দিন বাবলু প্রমুখ।
আন্দোলনকারী আবদুল্লাহ আল-যোবায়ের বলেন, প্রকৃত খুনি ও পরিকল্পনাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত না হলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে। বিচারই শহীদ পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে পারে।
শহীদ শ্রাবণের বাবা নেছার আহম্মদ বলেন, অনেক আসামি দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কেউ কেউ দেশে থেকেও ধরা পড়েনি। বিচার না হলে আমাদের সন্তানের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে।
শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার শিউলি বলেন, ৪ আগস্টের পর থেকে আমাদের জীবনের সব আনন্দ শেষ হয়ে গেছে। শুধু ন্যায়বিচারই আমাদের একমাত্র চাওয়া।
একাধিক হত্যা মামলার আইনজীবী মেজবা উদ্দিন ভুঞা বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা নিশ্চিত করেছেন—অস্ত্রধারীরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। অথচ মামলার ৬ হাজার ১৯৯ জন আসামির কেউই প্রকৃত অর্থে গ্রেপ্তার হয়নি।
ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ১ হাজারের বেশি আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। একটি মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। অন্যান্য মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
এসএইচডি/আরবি