ঢাকা: সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে কম ‘লড়াই’ করেনি রাশিয়া। মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, কথার যুদ্ধ থেকে শুরু করে ময়দানে অবস্থান।
পশ্চিমারা যখন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন ঘটাতে রীতিমত যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছে, তখন ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে মিত্রের পাশে ‘রক্ষা প্রাচীর’ হয়ে দাঁড়াতে কালক্ষেপণ করেনি রাশিয়া।
দীর্ঘদিন এমন অবস্থানে থেকে ‘খেলা’র পর এবার নতুন ‘অবস্থান’ তৈরি করে ‘খেলতে’ শুরু করেছে মস্কো। অবশ্য, নতুন এই অবস্থান তৈরির প্রেক্ষাপট তাদের সামনে এনেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্র-সিরিয়াই।
উভয়পক্ষই রাশিয়াকে ‘সন্ত্রাস’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আহ্বান জানিয়েছে- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, যে আহ্বানে সাড়া দিতে মস্কোর এই নতুন ‘অবস্থান’। অবস্থানটা ব্যাখ্যা করলে যেমন পশ্চিমাদের ভাবার অবকাশ রয়েছে- রাশিয়ার অভিযানের সুফল তাদের ঘরেই আসতে পারে; তেমনি আসাদ সরকারও ভাবতে পারে- রুশ বাহিনী তাদের হয়েই লড়ছে। আসলে মস্কো কাদের পক্ষ হয়ে মাথা ঘামাচ্ছে? এর উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে কিছু সময়।
এই অপেক্ষার সুতো টানতে টানতেই ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষকরা খুঁজেছেন সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক তৎপরতার বিভিন্ন দিক, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের লাভ-লোকসান। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য এই বিশ্লেষণটাই উপস্থাপন করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, সিরিয়ায় যুদ্ধটা চলছে বহুমুখী। মনস্তত্ত্বে-ময়দানে। একদিকে শিয়াপন্থি আসাদের পতন ঘটাতে সুন্নিপন্থি বিদ্রোহীদের যুদ্ধ, আরেকদিকে তাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি বাহিনীর যুদ্ধ। যুদ্ধ চলছে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও ইরাক-সিরিয়ার কিছু অঞ্চল দখলে নিয়ে ‘খেলাফত’ ঘোষণা করা সুন্নি সম্প্রদায়পন্থি ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে; এলাকা দখল নিয়ে সুন্নি সম্প্রদায়পন্থি আল নুসরা ফ্রন্ট ও শিয়াপন্থি আঞ্চলিক অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে। আর এ ময়দানের যুদ্ধ নিয়ে আরেক যুদ্ধ চলছে সৌদি আরব, ইরান, তুরস্ক, লেবানন, কাতার, বাহরাইন, ইসরায়েলসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে। সে যুদ্ধটা মনস্তাত্ত্বিক, ভূরাজনৈতিক।
মস্কো এই বহুমুখী যুদ্ধের ময়দানটায় নেমেছে ‘সন্ত্রাস দমনে‘- পশ্চিমাদের প্ররোচনায় শক্তি দেখাতে এবং আসাদ সরকারের অনুরোধে তাকে রক্ষা করতে। ইতোমধ্যে সিরিয়ার কিছু অঞ্চলে ‘সন্ত্রাসীদের’ আস্তানা লক্ষ্য করে কয়েক দফা হামলাও চালিয়েছে রাশিয়ার বিমান বাহিনী। সন্ত্রাস দমনে মস্কোর এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের জন্য কতটুকু লাভের? কতটুকইবা লোকসানের? এবারে সেই হিসাব কষা যাক।
>>>যে কারণে পশ্চিমাদের জন্য খারাপ খবর
ফের আসাদের ‘রক্ষা প্রাচীর’ রাশিয়া
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পাশে থাকার বিষয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তার দেশের নেতারা কখনোই কোনো ধরনের রাখঢাক রাখেননি। বরং রাসায়নিক গ্যাস ব্যবহার করে গণহত্যাসহ নানাভাবে রাষ্ট্র ধ্বংসে অভিযুক্ত আসাদের সরকারকে নিশ্চিহ্ন করতে পশ্চিমারা যুদ্ধের দামামা বাজালে রণহুংকার দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে যান পুতিনরা।
রুশ বিমান বাহিনী সিরিয়ায় ‘সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেও পশ্চিমারা তাদের অভিধানে দেখছে, এরা সন্ত্রাসী নয়, আসাদের বিদ্রোহী। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতপুষ্ট বিদ্রোহীরাই রুশ বিমান বাহিনীর হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে বেসামরিক নাগরিকরাও। অথচ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা ভেবেছিল, আসাদকে রক্ষা করতে রাশিয়া দখলদার আইএসসহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে। যার ফল ঘরে তুলবে আগে থেকেই আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করা পশ্চিমারা। আইএস দমন হলে- জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে ফের আসাদ উৎখাতে বিদ্রোহীদের সঙ্গে মনোনিবেশ করবে তারা।
যদিও অভিযান শুরুর আগে রুশ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দেমিত্রি পেসকভ সাফ বলে দিয়েছিলেন, ‘আমরা সিরিয়ার বৈধ সরকারের অনুরোধে বৈধতা নিয়ে এ অভিযান চালাচ্ছি- সন্ত্রাস ও সিরিয়ার সরকারের শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করতে। ’
এখন রাশিয়া যে তাদের দমনাভিযান পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহীদের ওপর চালাচ্ছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন সিরিয়ার সরকারবিরোধীদের জোটের মুখপাত্রই। তিনি জানিয়েছেন, রুশ বাহিনী আইএস’র ওপর নয়, বেসামরিক নাগরিকদের টার্গেট করেই হামলা চালাচ্ছে।
সেজন্য বলা হচ্ছে, আইএস জঙ্গি গোষ্ঠীসহ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়তে রাশিয়াকে প্ররোচনা দিয়ে এখন ‘বুমেরাং পরিস্থিতি’ই সামলাতে হচ্ছে পশ্চিমাদের। এমনকি ফল উল্টো হয়তো উঠতে যাচ্ছে আসাদ-পুতিনদের ঘরেই।
মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের আগুনে ঘি
পুরো মধ্যপ্রাচ্যই জাতিগত সংঘাতের আগুনে পুড়ছে। এই সংঘাতে মনস্তাত্ত্বিকভাবে কিংবা ময়দানে অবস্থানগতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ইরান, তুরস্ক, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন, কাতার, বাহরাইন এমনকি সৌদি আরবও। রাশিয়ার এই অবস্থান ও লড়াই যদি কার্যত শিয়াপন্থি বাশার আল-আসাদের পক্ষে স্পষ্ট হয়ে পড়ে, তবে বসে থাকবে না সিরিয়া, ইরান ও লেবাননের মতো শিয়া রাষ্ট্রবিরোধী সৌদি ও তুরস্কের মতো সুন্নি সম্প্রদায়পন্থি রাষ্ট্রগুলো।
ইতোমধ্যে রাশিয়ার সামরিক অভিযানকে ‘ভয়ংকর উস্কানি’ও আখ্যা দিয়েছেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের। তিনি বলেছেন, আসাদকে উৎখাতে প্রয়োজনে সামরিক পন্থাও অবলম্বনে বাধ্য হবে তার দেশ।
বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরব তাদের সুন্নি দেশগুলোর ভ্যানগার্ড মনে করে। সেই অবস্থান থেকে মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নিদের অবস্থান সংহত রাখার অংশ হিসেবে সিরিয়ার সুন্নি বিদ্রোহীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে সৌদি ও তার মিত্র দেশগুলো। রাশিয়ার অভিযানে এই বিদ্রোহীরা নিশ্চিহ্ন হতে থাকলে নিশ্চিতভাবেই আঁতে ঘা লাগবে সৌদি জোটের। আর আঁতে ঘা লাগার কারণে সৌদি যে ইয়েমেনে সুন্নি সম্প্রদায়পন্থি সরকারের সহযোগিতায় সামরিক পদক্ষেপ নিতে কালক্ষেপণ করেনি তা ইতোমধ্যেই বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে।
যদি পরিস্থিতি এতোদূর গড়ায়, তবে নিশ্চিতভাবেই তা মধ্যপ্রাচ্যসহ ওই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে দারুণ প্রভাব ফেলবে। সেক্ষেত্রে এই ময়দানে খেলতে নানামুখী ছক কষতে বেকায়দায় হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে ক্ষয়
এমনিতেই সিরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের নীতির কড়া সমালোচনা চলছে। সমালোচকরা মনে করেন, এই অঞ্চলে ওবামা প্রশাসনের নিষ্প্রভ ও নমনীয় নীতিই পুতিনকে এতোটা আগ্রাসী করতে পেরেছে। সিনেটর জন ম্যাককেইনের মতো নেতারাও মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার এই আগ্রাসী অবস্থান আমেরিকার প্রভাব হ্রাসেরই উদাহরণ।
বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের শিয়া নেতাদের নিয়ে পুতিন মধ্যপ্রাচ্যে যে বলয় গড়ে তুলছেন, তার পাল্টা কোনো বলয় গড়তে ব্যর্থতা দেখাচ্ছেন ওবামা। এ কারণে আসাদের আসন পোক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আর আসাদের আসন পোক্ত হলে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে আরও শক্তভাবে আধিপত্য বিস্তার করবে। সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের কেবল দর্শক সারিতেই থাকতে হবে।
>>>যে কারণে পশ্চিমাদের জন্য খারাপ খবর নয়
ভূরাজনীতিতে জটিলতায় পড়বে রাশিয়া
এখনও ইউক্রেন ও অধিকৃত ক্রিমিয়া নিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টসহ নীতি-নির্ধারকদের নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। এরমধ্যে যদি সিরিয়া নিয়েও বাড়তি ছক কষতে বসতে হয় রাশিয়ার নেতাদের, তবে তাদের ভূরাজনৈতিক নীতি সাজানোর জটিলতায়ই পড়তে হবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সিরিয়া নিয়ে মাথা ঘামানোর ফলে রাশিয়ার নীতি-নির্ধারকদের মনোজগত পূর্ব ইউরোপ থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। আর এটা নিশ্চিতভাবেই পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো, বিশেষত ইউক্রেনের জন্য ভালো খবর হতে পারে।
তাছাড়া, সিরিয়ায় আসাদের পক্ষে রাশিয়ার সামরিক তৎপরতা যদি ভেস্তে যায়, তাহলে তুরস্ক, উপসাগরীয় দেশগুলোসহ এতদঅঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসীদের তৎপরতা আরও বেড়ে যাবে। আর এটা খোদ রাশিয়ার জন্যই বিপদের কারণ হতে পারে। কারণ, সিরিয়া ও ইরাকে রাশিয়ার প্রায় ২৫শ’ নাগরিক আইএস জঙ্গিদের হয়ে যুদ্ধ করছে। রাশিয়া ব্যর্থ হলে এই নাগরিকরা স্বদেশে ঘাঁটি গেড়ে জাল বিস্তার করতে চাইবে না- তা নিশ্চিত করে কে বলবে?
আইএস উৎখাত
সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল এলাকা দখলে নিয়ে খেলাফত ঘোষণার পর আগ্রাসন আরও চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস। রাশিয়া আসাদ সরকারকে রক্ষা করতে বিদ্রোহীদের পাশাপাশি এই জঙ্গি গোষ্ঠী নির্মূলেও নিশ্চিতভাবে অভিযান চালাবে। কেবল আসাদ সরকারকে রক্ষাই নয়, মস্কো নিজেদের স্বার্থেই অর্থাৎ রাশিয়ার যে ২৫শ’ নাগরিক আইএসের হয়ে লড়ছে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সেই জঙ্গিদের নির্মূলেও লড়াই করবে। আর সেটা আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইরত পশ্চিমাদের জন্য সুখবর বৈকি।
বিদ্রোহীদের অবিরাম আঘাত এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়া বাশার আল-আসাদ রাশিয়ার সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠালে বরাবরের মতো কালক্ষেপণ না করে ময়দানে নামতে প্রস্তুতি নিতে থাকে মস্কো, এরমধ্যে পশ্চিমারা ‘সন্ত্রাস’র বিরুদ্ধে মাঠে নামতে পরোক্ষভাবে প্ররোচিত করলে পার্লামেন্টের অনুমোদন সামরিক বাহিনীকে রণক্ষেত্রে নামিয়ে দেন ভ্লাদিমির পুতিন।
অবশ্য, পুতিনদের এই অবস্থান বা লড়াই নিয়ে বিভিন্নমুখী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা নিজেদের বিভ্রান্তির কথা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। রুশ বাহিনী কি আইএস জঙ্গিদের লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে, নাকি বেসামরিক নাগরিকদের টার্গেট করছে- এ নিয়ে স্পষ্ট সংশয় প্রকাশ করছেন তারা। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কার্যত মধ্যপ্রাচ্য ও এতদঅঞ্চলে ‘পশ্চিমা আধিপত্যের জাল’ কেটে দিতে এবং ‘সমাজবাদী চেতনার’ আসাদকে ক্ষমতায় ধরে রাখতেই মস্কো এ নতুন ‘খেলা’ শুরু করেছে। আসাদকে রক্ষায় যদি মস্কোকে আইএস নির্মূল করতে হয়, তারা সেটাও করবে; যদি পশ্চিমা ও আরব জোটের মদতপুষ্ট সুন্নি বিদ্রোহীদের নির্মূল করতে হয়, তারা সেটাও করবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৫
এইচএ/