মে মাসের একরাতে প্রায় ১০০ জন পুলিশ মধ্য ভারতের পাহাড়ী কাঁচা রাস্তা ধরে মাওবাদীদের খোঁজে এগুতে থাকেন। গুমিয়াপিন গ্রামের দিকে।
সত্যি বলতে কি, সবকিছু হারিয়ে তারা সবাই সেদিন বেঁচে গিয়েছিল। মিদিযামি (৫০) জানান, নকশাল বাহিনীর সদস্য সন্দেহে পুলিশ দুই তরুণকে গুলি করে মেরে ফেলে। তার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। বাড়ির ভিতরে জমা করে রাখা ধান, বিভিন্ন শস্য, কাপড়চোপড়, সারা জীবনের সঞ্চয় কিছু টাকাকড়ি সব পুড়ে যায়।
গত ১২ মাস ধরে ভারতীয় নিরাপত্তা নিরাপত্তা বাহিনী মাওবাদীদের নির্মূল করার চেষ্টা করছে। একে একে ধরে, গ্রামের পর গ্রামে। তবে সাধারণ গ্রামবাসী ও চরমপন্থীদের মধ্যে পার্থক্য না করতে পারার কারণে এই অভিযান ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। গুমিয়াপিন গ্রামের লোকজনের ক্ষোভও খুবই প্রকাশ্য। মিদিযামির স্বামী গুদ্দি কুটা বলেন, ‘তারা (নিহত দুই তরুণ) আমাদের লোক। অথচ ছত্তিশগড় রাজ্যের দান্তেওয়াদা জেলার পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট অমরেশ মিশ্র বলছেন উল্টো কথা। ‘তারা মাওবাদী গেরিলা। ’ তিনি বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার যে অভিযোগ এসেছে তা শত ভাগ ভুয়া কথা। পুলিশের দুর্নাম ছড়াতে নকশালরা নিজেরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এটা তাদেরই চাল। ’
গুমিয়াপালের মতোই অনেক গ্রামে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযানে ভারতের সরকার হারতে পারে, জিততেও পারে। তবে এটা ঠিক, ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী বহুবছর ধরে বেড়ে উঠা চরমপন্থীদের অবহেলা করছে। তারা আশা করেছিলো, বিদ্রোহীরা পালিয়ে যাবে, মারা পড়বে। তবে তা ঘটেনি। বরং গত দশক ধরে প্রান্তিক গ্রাম ও বনাঞ্চলে চরমপন্থা আরও সংগঠিত ও বিস্তৃত হয়েছে। ভারতের অর্থনৈতিক উলম্ফন শহরাঞ্চলে প্রভাব ফেললেও এর পরিবর্তন হয়নি। পূর্বাঞ্চলের নকশালবাড়ি নামের গ্রামটি এই আন্দোলনের উত্থানকেন্দ্র। সেই থেকে এদের নাম নকশাল। এ মুর্হূতে ভারতের ৬২৬টি জেলার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি অঞ্চলে এদের উপস্থিতি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ে এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ’
কাশ্মীরে অস্থিরতা ও জঙ্গীদের হুমকি অত্যন্ত জরুরি ইস্যু হলেও মাওবাদীরা প্রমাণ করেছে রাজনৈতিকভাবে বা সামরিক দিকে থেকে তারা আরো প্রতিরোধ মতাসম্পন্ন। মাওবাদী সহিংতায় ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার লোক নিহত হয়েছে। চলতি বছর এ সংখ্যাটা ৯৯০।
এ মুহূর্তে ভারত সরকার নকশাদের প্রতি ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছে। সরকার বুঝতে পেরেছে যে, মাওবাদীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদের দখলে থাকা বনাঞ্চলের কথা বাদ দিলেও। ওই সব জঙ্গলে সরকার ইস্পাত কারখানা, পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করতে চাচ্ছে। সেখান থেকে কয়লা, লৌহ আকরিক ও অন্যান্য খনিজ দ্রব্য উত্তোলন করাও সরকারের আকাক্সা। আর এসব জঙ্গলেই রয়েছে মাওবাদীদের শক্তিশালী ঘাঁটি। এই সংঘর্ষের কেন্দ্রীয় মঞ্চ হচ্ছে দান্তেওয়াদা। এখানেই রয়েছে দেশের সবচেয়ে দামি লৌহ আকরিকের খনি। অথচ ভারত বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।
নকশালদের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াইয়ের কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এই প্রথাগত বাহিনী নিয়ে গেরিলা আন্দোলনের মোকাবিলা করা কঠিন। তবে এটি একটি বিরাজমান সমস্যা। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর জওহরলাল নেহেরু কল্পনা করেছিলেন, ‘প্রতিটি চোখ থেকে পানি মুছে ফেলবেন’। আজকের নেতাদের তুলনামূলক কম সংবেদনশীল দৃষ্টিশক্তি রয়েছে। গত মে মাসে একটি বক্তৃতায় মনমোহন সিং ভারতের তীব্র দারিদ্র্য, গণনিররতা ও অসুখের কথা স্বীকার করেন। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, যেখানেই প্রয়োজন সেখানেই উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। ’ ভারতের এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে বলা যায়, কয়েক দশকের সমাজতন্ত্র যা পারেনি, একটি সমৃদ্ধ ও উদারীকৃত অর্থনীতির মাধ্যমে তা সম্ভব হতে পারে। এখনো দেশটির ৮০ কোটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না। ‘রেড সান: ট্রাভেলস ইন নক্সাল’ বইয়ের লেখক সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘মানুষের অসন্তুষ্টির ওপর ভর করে মাওবাদীরা টিকে আছে ও বলিষ্ঠ হচ্ছে। ভারত সরকার যার প্রতিশ্রতি দিয়েছে তা পালন করেনি। এর ফলে অত্যন্ত গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ’--টাইম অবলম্বনে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১০