লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরে টানা চারদিনের বৃষ্টি যে পরিমাণ পানি জমা হয়েছে, তা সরতে পারছে না। শুক্রবার (১১ জুলাই) বৃষ্টিপাত না হলেও ৭ জুলাই সকাল থেকে শুরু হওয়ায় বৃষ্টির পানি এখন জায়গায় জায়গায় জমে আছে।
পৌর এলাকাসহ জেলার সর্বত্র জলাবদ্ধতার কবলে। পানি প্রবাহের জন্য পূর্বে যে রাস্তা ছিল, সেগুলো বাঁধ দিয়ে এবং ভরাট করে রাখা হয়েছে। ফলে ভারী বৃষ্টি হলেই দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
সবচেয়ে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কবলে লক্ষ্মীপুর পৌর এলাকা। এখানে প্রয়োজনীয় ড্রেনেজ ব্যবস্থা কিংবা পানি নিষ্কাশনের পথ একেবারে নগণ্য। শহর কেন্দ্রিক ড্রেন থাকলেও শহরের বাইরে কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে এসব এলাকায় নিচু জমি, পুকুর ও জলাশয় প্রতিনিয়ত ভরাট হয়ে পড়েছে। যাতায়াতের পথ তৈরি করে পানির নামার পথ বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
পানি প্রবাহের পথ স্বাভাবিক না রেখে অপরিকল্পিত ভরাটের কারণে জলাবদ্ধতার কবলে পড়তে হয়৷ কোথাও আবার মাছ চাষের কারণে পানি প্রবাহের রাস্তা বন্ধ রাখা হয়।
অন্যদিকে পৌর এলাকার বাইরে থাকা যেসব খাল বা নালা রয়েছে সেগুলো ভরাট হয়ে পড়েছে। অবৈধ দখলদার এবং দূষণের কবলে পড়ে খালগুলো সংকুচিত হয়ে আছে। তবে জলাবদ্ধতার পেছনে প্রশাসনের আগাম এবং কার্যকরী প্রদক্ষেপ না নেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয়দের খামখেয়ালিপনা ও অসচেতনতার অভাবকেও দায়ি করা হচ্ছে।
গত বছরের আগস্টের শেষের দিকে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ছে লক্ষ্মীপুরবাসী। ফেনী থেকে আসা উজানের পানি এবং ভারী বৃষ্টিপাতের পানিতে ডুবে যায় জেলার বিভিন্ন অঞ্চল। চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তির পাশাপাশি বন্যায় কাঁদিয়েছে লক্ষ্মীপুরবাসীকে। জেলা সদরের প্রধান দুটি খাল রহমতখালী ও ওয়াপদা খাল হয়ে ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পানি মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়ে। এছাড়া নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, সুবর্নচর, সদর এবং লক্ষ্মীপুর সদরের দক্ষিণাংশ, কমলনগর, রামগতি উপজেলার পানি ভুলুয়া নদী হয়ে মেঘনায় পতিত হয়।
আর ডাকাতিয়া নদী হয়ে জেলা সদরের উত্তরাংশ ও রায়পুর উপজেলার পানি মেঘনায় পড়ে। এছাড়া রামগঞ্জের বীরেন্দ্র খাল দিয়ে ওই উপজেলার পানি নিষ্কাশন হতো।
তবে জেলার প্রধান এসব খালের অবস্থা একেবারে নাজুক। দখল এবং দূষণের কবলে পড়ে সবগুলো খাল অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। রায়পুরের এক সময়ের প্রবাহমান ডাকাতিয়া নদীর পৌরসভার অংশ এখন 'মরা ডাকাতিয়া' হিসেবে নাম পেয়েছে।
জেলা সদরের ওয়াপদা খালে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলেও উল্টো চিত্র রহমতখালী খালের। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে পশ্চিমে লক্ষ্মীপুর সদরের মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত প্রায় ৫২ কিলোমিটার অংশে শত শত মাছ শিকারের বাঁধ ও জাল রয়েছে। এছাড়া খালের মূল প্রস্থ ১২৮ মিটার থাকলেও এখন তা অনেকাংশে সংকুচিত হয়ে গেছে। বাজার কেন্দ্রিক বর্জ্য ফেলে খালের বিভিন্ন স্থান ভরাট করা হয়েছে। দুইপাশে গড়ে উঠেছে অবৈধ দখলদার।
একই অবস্থা কমলনগর ও রামগতি উপজেলার ভুলুয়া নদীরও। গেল বছরের ভয়াবহ বন্যা ও জলাবদ্ধতা ছিল ভুলুয়ার দুই পাড়ে।
রামগঞ্জের বীরেন্দ্র খালটিও দখলে-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
খালের উপর সরকারিভাবে যেসব ব্রিজ এবং কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো একেবারে নিচু এবং কম দৈর্ঘের। ফলে ব্রিজ-কালভার্টের নিচ দিয়ে পানি প্রবাহে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং খননের দাবি জানিয়ে গত বছর উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার বাসিন্দা আবদুস সাত্তার পলোয়ান। রিট দায়েরের পর রহমতখালী ও ভুলুয়া নদীতে কিছু অভিযান চালিয়ে যতসামান্য মাছ শিকারের জাল-বাঁধ অপসারণ করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পানি প্রবাহের জন্য কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চলতি শুষ্ক মৌসুমেও ভুলুয়াতে শুধুমাত্র জাল অপসারণ করেই অভিযান দেখানো হয়েছে। খাল খনন বা অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
রহমতখালী খালের পৌরসভার মাদাম এলাকায় কচুরিপানা অপসারণ করা হলেও সেখানে আবারও কচুরিপানার জট বেঁধে আছে৷ কিন্তু খালের তলদেশ থাকা বর্জ্য অপসারণ এবং দখলদার উচ্ছেদ করা হয়নি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মান্দারী ও জকসিন বাজার এলাকায় কিছু বর্জ্য অপসারণ করা হলেও বাস্তবতার দিক দিয়ে তা ছিল সামান্য।
তবে সদর উপজেলার বাঙ্গাখাঁ, চররুহিতা এবং কমলনগরের হাজিরহাট বাজারের জারিরদোনা খালের ওপর থাকা কিছু স্থাপনা অপসারণ করে প্রশাসন। কিন্তু জারিরদোনা খালে থাকা বড় বড় স্থাপনা ও ভবন উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। খালের বর্জ্য অপসারণও করা হয়নি।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ সেখানে ভারী বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা ও আসন্ন দুর্যোগের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
সভায় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জামশেদ আলম রানা বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য জেলা, উপজেলা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বয়ে আমরা খালের ওপর থাকা অবৈধ যেসব অবকাঠামো রয়েছে, সেগুলো অপসারণ করেছি। বর্জ্য অপসারণ ও বাঁধ কেটে দেওয়া হয়েছে। ১০-১২টি অভিযান পরিচালনা করেছি। অভিযানের কারণে সুফল এখন লোকজন পাচ্ছে। সদর উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় জলবদ্ধতা দেখা দিয়েছে, লোকজন আমাদের কাছে রিপোর্ট করছে। আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, কোন পয়েন্ট দিয়ে জলবদ্ধতা নিরসনের কাজ করা যেতে পারে, সে পয়েন্টগুলো বের করা সম্ভব হচ্ছে না। জলবদ্ধতা নিরসনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
লক্ষ্মীপুর পৌর প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, জলাবদ্ধতার পেছনে মূলত নাগরিক সচেতনতার অভাব দায়ী। নাগরিকরা যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলায় ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অবাধে খাল দখল, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও পুকুর ভরাটের কারণেও পানি নিষ্কাশনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার সচেতন করা হলেও তেমন সাড়া মিলছে না। বিভিন্ন স্থানে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে আমরা খালের উচ্ছেদ অভিযান এবং খাল পরিষ্কার অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
জেএইচ