চাঁদপুর: শহীদ রাসেল বকাউল (২২)। খুব টগবগে যুবক।
শহীদ রাসেল বকাউলের জন্ম ২০০২ সালের ১০ জুন। তার বাবার নাম নুরুল ইসলাম বকাউল (৭০)। মায়ের নাম লীলু বেগম (৫৬)। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার রাজারগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব রাজারগাঁও গ্রামের বকাউল বাড়িতে জন্ম এ শহীদের। বাবা নুরুল ইসলাম একজন কৃষক। মা লীলু বেগম গৃহিণী।
নুরুল ইসলাম বকাউলের ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ে। বড় মেয়ে হাসিনা (৩৭) বিবাহিত। বড় ছেলে হাসানাত বকাউল (৩৪) থাইগ্লাসের ব্যবসা করেন। মেজ ছেলে কাউছার দিনমজুর। দ্বিতীয় মেয়ে রেখা (৩০) বিবাহিত এবং গৃহিণী। তৃতীয় ছেলে রুবেল (২৮) মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন। পেশায় মসজিদের ইমাম ও মক্তবের শিক্ষক। ভাইদের মধ্যে সবার ছোট শহীদ রাসেল বকাউল। ছোট মেয়ে রেহানা স্থানীয় রাজারগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে।
রাসেল ছোট বেলায় স্থানীয় রাজারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এরপর সংসারের অভাব অনটনের কারণে আর পড়তে পারেননি। ১২ বছর আগে বড় ভাই হাসনাতের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ শানার পাড়ে থাই গ্লাসের দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখানে রৌশন আরা কলেজ রোডে মদিনা ট্যাংকির পাশে আরিফ মিয়ার বাসায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন দুই ভাই।
রাসেলের মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা করেন বড় ভাই হাসানাত বকাউল। তিনি বলেন, জুলাই মাসের শুরু থেকেই রাসেল ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয়। তবে আমাকে এ বিষয়ে জানায়নি। গোপনে মিছিলে যেত। ৫ আগস্ট সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হয়। তার আগে আমি কাজে বের হই। তাকে ৫০ টাকা দিয়ে যাই সকালের নাশতা খাওয়ার জন্য। দুপুরে কাজ শেষে আমি বাসায় এসে ঘুমিয়ে যাই। বিকেল সোয়া ৩টায় অজ্ঞাত নম্বর থেকে খবর পাই রাসেল সকাল ১০টায় যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
হাসানাত বলেন, আমাদের বাড়ির আবুল বাসার বকাউল ঢাকায় থাকেন। তিনি আমাকে নিয়ে যান যাত্রাবাড়ী থানার সামনে। সেখানে গিয়ে খোঁজ পাইনি। লোকজন জানায় অনেক লাশ মাতুয়াইল হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে রাসেলকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ওই হাসপাতালের লোকজন জানায়-রাসেলের কিডনির পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। ওই হাসপাতাল থেকে রাত ৯টায় অ্যাম্ব্যুলেন্স করে বাড়িতে রওনা হই। রাত ১২টায় বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
এরপর পরদিন ৬ আগস্ট সকালে গোসল দিয়ে ৯টার দিকে রাজারগাঁও কেন্দ্রিয় ঈদগা মাঠে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে বকাউল বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শহীদ রাসেল বকাউলের গ্যাজেট নং-৩৬৫। মেডিকেল কেইস আইডি ২২৩৬১। এই পর্যন্ত সরকারি অনুদান পেয়েছে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ১০লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। একই ফাউন্ডেশন থেকে নগদ ৫ লাখ টাকা। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা, হাজীগঞ্জ বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হকের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা। সর্বপ্রথম বাড়িতে এসে নগদ ১০হাজার টাকা এবং খাবার দিয়ে যান হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
ছোট বোন রেহেনা বলেন, পরিবারের সবার ছোট আমি এবং স্কুলে পড়ি। যে কারণে ভাই আমাকে খুবই আদর করতেন। আমার খোঁজ নিতেন সব সময়। ভাইয়ের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় ফোনে কথা হয়েছে। আমাকে বলতেন তুমি পড়, তোমার পড়ার খরচ আমি দেবো।
শহীদ রাসেলের বড় ভাইয়ের স্ত্রী শাহীনুর বেগম বলেন, খুবই হাসিখুশি ছিলে রাসেল। বাড়িতে আসলে এলাকার সহপাঠীদের নিয়ে খেলাধুলা করতো। সময় পেলে আমার সঙ্গে গল্প করতো। আমার স্বামীর কাছে থেকেই সে কাজ শিখেছে।
রাসেলের বাবা নুরুল ইসলাম বকাউল বলেন, ছেলের এভাবে মৃত্যু হবে কোনোদিন কল্পনাও করিনি। মনে হয় আমার ছেলে এখনো বেঁচে আছে। বাড়িতে আসবে। গেল বছর কোরবানির ঈদে সর্বশেষ বাড়িতে আসে। সবার সঙ্গে ঈদে আনন্দ করেছে। তারপর কাজে চলে যায়। এর মধ্যে আর বাড়িতে আসেনি। তবে এসেছে লাশ হয়ে। বাবা হয়ে আমার ছেলের লাশ বহন করতে হয়েছে।
মা লীলু বেগম বলেন, বড় ছেলের সঙ্গে আমার ছোট ছেলে থাকতো। সে জন্য বেশি চিন্তা করতাম না। মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে ফোনে কথা হয়েছে। আমি মোবাইল চালাতে জানি না। অন্যের সাহায্য নিয়ে কথা বলতাম। ছেলেকে হারিয়ে আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ছেলের নানা কাজগুলো আমার চোখে ভেসে উঠে। দাফনের আগে ছেলেকে একটু ছুঁয়ে দেখতেও পারিনি। এসব বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
এদিকে রাসেল হত্যার ঘটনায় মৃত্যুর ১৭দিন পরে ২২ আগস্ট ঢাকা সিএমএম আদালতে মামলা করেছেন বড় ভাই হাসানাত বকাউল। ওই মামলায় যাত্রাবাড়ী থানার ৮ থেকে ১০ জন পুলিশকে বিবাদী করা হয়।
বাদী হাসানাত বকাউল বলেন, মামলা করার জন্য আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন চাঁদপুর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মমিনুল হক। পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা আদালতের কাছে এই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও সচিক বিচার দাবি করছি।
জেএইচ