চট্টগ্রাম: জ্বর-সর্দি বা ডায়রিয়া হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনে খাওয়ার প্রবণতা বেশি। বড়দের পাশাপাশি শিশুদের অসুখ তাড়াতাড়ি সারাতে অহেতুক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফার্মাকোলজি বিভাগ ও কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের উদ্যোগে চান্দগাঁও ওয়ার্ডের ৫০টি ফার্মেসির ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, এক-দুইদিন জ্বর, শ্বাসকষ্ট বা ডায়রিয়ার জন্য ৭২ শতাংশ ওষুধ বিক্রেতা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন।
গবেষকরা বলছেন, নবজাতকের শরীরে উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির কারণে এনআইসিইউতে ভর্তি হওয়া নবজাতকের মৃত্যু বাড়ছে। ২০২২ সালেই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে ৩০ লাখেরও বেশি শিশু প্রাণ হারিয়েছে।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল এবং শেভরন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক হাজার রোগীর ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ৪০ শতাংশ নবজাতক ও শিশুর শরীর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। এছাড়া কিশোর ও তরুণদের মাঝেও বেড়েছে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যহীনতা। বিভিন্ন হাসপাতালে নিউমোনিয়া ক্লেবজিয়েলা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাধিক ব্যবহৃত ২০টি অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধ ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করে কয়েকটির কার্যকারিতা সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে। সেফুরক্সিম, সেফিক্সিম, সেফোট্যাক্সিম, সেফটাজিডাইম, সেফেপিম, সেফট্রিয়াক্সন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অণুজীবের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ৭৯ শতাংশ, ৭৭ শতাংশ, ৭৪.৯ শতাংশ, ৭১ শতাংশ, ৬৬ শতাংশ এবং ৬৫ শতাংশ হারে অকার্যকর দেখা গেছে।
গবেষণায় যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক ডা. ওয়াজির আহমেদ। তিনি জানান,‘অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ ও পুরোপুরি কোর্স সম্পন্ন না করার কারণে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স দেখা দেয়। এক হাজার রোগীর ৫০ শতাংশই ছিল শিশু, যাদের ৪০ শতাংশই তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অণুজীবে সংক্রমিত। ৭০ শতাংশ মানুষের চিকিৎসায় অন্তত একটি অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে’।
তিনি আরও জানান, গবেষণায় নিউমোনিয়া রোগীদের মধ্যে মাল্টি-ড্রাগ প্রতিরোধের ব্যাকটেরিয়ার বিভিন্ন নমুনার উচ্চ বিস্তার খুঁজে পাওয়া গেছে। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিন এনডিএম-১ এর উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ। এছাড়া, এসএইচভি-১১ এর উপস্থিতি ৪০ শতাংশ ও ইউজিই জিনের বিস্তার প্রায় ৩০ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের সাম্প্রতিক গবেষণায় এনআইসিইউতে ভর্তি হওয়া নবজাতকের ৮১ শতাংশের শরীরে কার্বাপেনেম প্রতিরোধী ক্ল্যাবসিয়েলা নিউমোনির (সিআর-কেপিএন) জীবাণু মিলছে। ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে কার্বাপেনেম অত্যন্ত কার্যকরী। কার্বাপেনেম প্রতিরোধী ক্লেবসিয়েলা নিউমোনি হলো একটি ব্যাকটেরিয়া, যা কার্বাপেনেম নামক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে।
অপরদিকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর বিপুল সংখ্যক রোগী অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে। হাসপাতালের বেসিন থেকে পানি, নালার পানি, বিছানার চাদর, দেয়ালের বিভিন্ন নমুনায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়। এ ধরনের অণুজীব মা থেকে শিশুতে প্রবাহিত হতে পারে। পোল্ট্রি ও গবাদি পশুকে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ কিংবা অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এমন অকার্যকারিতা সৃষ্টি করছে।
সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে আগ্রাবাদ, ডবলমুরিং, পাঁচলাইশ, হালিশহর, বায়েজিদ ও বাকলিয়া এলাকায় এবং সীতাকুণ্ড, পটিয়া, হাটহাজারী ও চন্দনাইশ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
চবি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের গবেষকেরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ১৫০টি খাবার পানির নমুনা সংগ্রহ করেন। গবেষণাগারে নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হলে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নমুনায় টাইফয়েড জ্বর সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত হয়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলোর বেশিরভাগই ছিল অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। আটটি নমুনার মধ্যে ৮৭.৫ শতাংশ মাল্টিড্রাগ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া হিসাবে চিহ্নিত হয়। কো-ট্রাইমক্সাজল এবং সিপ্রোফ্লক্সাসিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক এখনও এই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর হলেও বেশ কয়েকটি ব্যাকটেরিয়া ওষুধগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
সম্প্রতি চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ বেড়েছে। সঙ্গে আছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। দুটিই ভাইরাসজনিত রোগ। এতে বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। চিকুনগুনিয়া আক্রান্তদের অস্থিসন্ধিতে প্রদাহ হয়ে ব্যথা বাড়িয়ে দেয়। এই ব্যথা কমাতে অ্যান্টিবায়োটিকের তেমন কোনো ভূমিকা নেই বলে জানান চিকিৎসকরা।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সৌমিত্র শেখর বলেন, ব্যথার জন্য বিশেষ কিছু ওষুধ প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে। প্যারাসিটামল খেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যথা কমে যায়। অন্য ব্যথার ওষুধ যেমন: আইবুপ্রোফেন, ডাইক্লোফেনাক, ন্যাপ্রোক্সেন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়। তেমনি যেকোনো জ্বরেই অ্যান্টিবায়োটিক প্রযোজ্য নয়।
তিনি বলেন, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে জ্বর হলে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়। টাইফয়েড, নিউমোনিয়া বা শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ, প্রস্রাবে প্রদাহ, মস্তিষ্কে প্রদাহ ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজনিত রোগ। সঠিক সময়ে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করলে জীবনহানিও হতে পারে। তবে কোন রোগে কোন অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর হবে, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসকই নির্ধারণ করবেন। অ্যান্টিবায়োটিক যেমন প্রাণ রক্ষাকারী, তেমনি এর অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার রেজিস্ট্যান্স তৈরি করে। সেক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে আর ওষুধ কাজ করে না।
এসি/টিসি