চাঁদপুর: দুধের উৎপাদন কম দেশের এমন ৫০ উপজেলায় ১০০ সমবায় সমিতি গঠন করে সরবরাহ বাড়াতে ২০২২ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এর মধ্যে রয়েছে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলা।
সম্প্রতি উপজেলার দুটি দুগ্ধ সমিতির ঋণগ্রহীতাদের বাড়িতে গিয়ে ও ৬১ জনের মাঝে অনুসন্ধান করে মিলেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
তথ্য মিলেছে, ২৯ জনই ঋণের টাকা দিয়ে কোরবানিতে বিক্রির জন্য পশু কিনেছেন, অন্যের গোয়াল ঘর দেখিয়ে ঋণ নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। কয়েকজনের নামের টাকা নিয়েছেন একজন। এই ধরনের অনিয়মের তথ্যের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে উপজেলা সমবায় দপ্তরও।
সরেজমিন অনুসন্ধানে ‘দুগ্ধ ঘাটতি উপজেলায় দুগ্ধ সমবায়ের কার্যক্রম সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি অনেক ঋণগ্রহীতার বাড়িতে। ঋণ বণ্টন হয়েছে উপজেলার ১৬ ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র ৩ ইউনিয়নে।
চান্দ্রা দুগ্ধ সমবায় সমিতির ৫০ জন বালিথুবা ইউনিয়নের। গাজীপুর দুগ্ধ সমবায় সমিতির ৫০ জন হলেন সুবিদপুর ও পাইকপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা। বাকি ১৩ ইউনিয়নে ঋণ পাওয়ার যোগ্য গ্রহীতা থাকলেও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। দুটি সমিতিই গঠন হয় ২০২৩ সালে।
উপজেলা সমবায় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি চান্দ্রা বাজারে দুটি দুগ্ধ সমিতির ১০০ জন ঋণগ্রহীতাদের মাঝে উন্নত জাতের গাভি কেনার জন্য ১ লাখ ৬০ হাজার করে ঋণের চেক প্রদান করা হয়। প্রকল্প পরিচালক তোফায়েল আহম্মদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে এসব চেক ঋণগ্রহীতাদের হাতে তুলে দেন। ঋণ বিতরণের প্রায় ৪ মাস পর অর্থাৎ এপ্রিল মাসেও অনেক ঋণগ্রহীতা গাভি কেনেননি। তবে একজন গ্রাহক তার ঋণের টাকা ফেরত দিয়েছেন।
চান্দ্রা দুগ্ধ সমবায় সমিতি: এই সমিতির মাধ্যমে ঋণ পেয়েছেন ৫০ জন। ঋণগ্রহীতা ২৯ জনের মধ্যে অনুসন্ধান চালানো হয়। এর মধ্যে ১৭ জন গাভি কেনেননি। ঋণের টাকা বিনিয়োগ করেছেন অন্য খাতে।
ঋণের টাকা যথাযথ বিনিয়োগের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি সকদীরামপুর গ্রামের সফিকুর রহমান ও মদনেরগাঁও গ্রামের জহিরুল হক (আরিফ) - এর বাড়িতে। জহিরুল হক উপজেলা প্রাণিসম্পদের আওতায় একটি প্রকল্পে চাকরি করেন। তার মা ফয়েজুন্নেছা বলেন, ঋণের টাকা দিয়ে তারা কোরবানিতে বিক্রির জন্য ষাঁড় কিনেছেন।
সকদীরামপুর গ্রামের ঋণগ্রহীতা নাজমা আক্তার। তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানেন না কত টাকা ঋণ নিয়েছেন এবং কী কাজে! পরে জানালেন, তার ভাই ইসমাইল জানেন এই বিষয়ে। জানা গেল, ইসমাইল ফেলকন নামে আরেক সমিতির মালিক। তিনি নিজে এবং তার বোনের নামে ঋণ নিয়ে অন্য কাজে বিনিয়োগ করেছেন। একই সমিতির আবু ছালেহ মো. বারাকাত উল্লাহ ঋণ নিয়ে গাভি কেনেননি।
এসব ঋণগ্রহীতা সবাই বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের। এর মধ্যে মিনু বেগম, তফুরী বেগম, মো. নুর মিয়া, মো. ওয়াসিম হোসেন, ফাতেমা বেগম, নাছির উদ্দিন, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন গাজী, মো. সেলিম মিয়া, ফাহিমা আক্তার ও রৌশন আরা বেগম গাভী কেনেননি। এদের মধ্যে ওয়াসিম হোসেন ঋণের টাকায় নিম্নমানের ওষুধ কিনে মজুদ করেছেন। স্থানীয় ফার্মেসিতে তিনি এসব ওষুধ বিক্রি করেন। তার বাড়িতে গিয়ে গোয়াল ঘরের অস্তিত্ব মেলেনি।
ঋণগ্রহীত মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন। তিনি চান্দ্রা দুগ্ধ সমিতির সমন্বয়ক। তিনি নিজে, তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম, ঋণগ্রহীতা নুরুন্নাহার আক্তার লাকী ও মো. নাছির উদ্দিন ঋণের টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন তাদের পূর্বের গরুর খামারে। লাকী ও নাছির উদ্দিনের গাভী দেখার জন্য বাড়িতে গেলে সবাই একই খামার দেখান। তাদের এই খামারে আছে ২৮টি ষাঁড়। কোনো গাভি নেই। এসব ষাঁড় বিক্রি করবেন কোরবানির হাটে। এসব তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে ঋণগ্রহীতা শাহাবুদ্দিন।
গাজীপুর দুগ্ধ সমবায় সমিতি: এই সমিতির মাধ্যমে ঋণ পেয়েছেন ৫০ জন সদস্য। ঋণগ্রহীতা ৩৩ জনের মধ্যে অনুসন্ধান চালানো হয়। এর মধ্যে ১৪ জনই গাভি কেনেননি। সমতিরি ঋণগ্রহীতা সাখাওয়াত হোসেন, রাজু হোসেন, মো. কাইয়ুমের বাড়িতে গিয়ে গরুর কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। তারা অন্যের গোয়াল ঘর দেখিয়ে ঋণের টাকা নিয়েছেন। তাদের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
সাখাওয়াত মুন্সিরহাট বাজারে জুতার ব্যবসায়ী, রাজু বাড়িতে থাকেন না এবং কাইয়ুম বালু ব্যবসায়ী। গোয়াল ঘর ঠিক করে গরু কিনবেন বলে জানালেন কাইয়ুম। গোবার চিত্রা গ্রামের মোহাম্মদ রাশেদ খান ও নুর হোসেন খানের বাড়িতে গিয়ে গোয়াল ঘরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তাদের পরিবারের সদস্যরা জানালেন, ঋণ নিলেও তারা কোনো গরু কেনেননি।
পার্শ্ববর্তী ঘড়িহানা গ্রামের সরদার বাড়িতে বেশ কয়েকজন নিয়েছেন ঋণের টাকা। ঋণ নেওয়ার আগ থেকেই তাদের অনেকের গোয়ালঘর এবং বিভিন্ন ধরনের গরু আছে। এই বাড়ির জসিম উদ্দিন মিন্টু ছিলেন গাজীপুর দুগ্ধ সমিতির সমন্বয়ক। তিনি নিজ বাড়ির লোকদের এবং আশপাশের ১১ জনের ঋণ নেওয়ার কাজে সহযোগিতা করেন। এদের মধ্যে অনেকেই আগ থেকে কোটি টাকা বিনিয়োগ করে খামার করেছেন।
জসিম উদ্দিন বলেন, এই ঋণ বিতরণের সময় সমিতিতে যাদের নাম ছিল, চূড়ান্ত করার দিন তা পাওয়া যায়নি। উপজেলা সমবায় অফিসার এবং ওই কার্যালয়ের কর্মচারীরা তালিকা চূড়ান্ত করেছেন। ওইদিন আমি উপস্থিত হয়ে দেখলাম রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপস্থিতি। ওই সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের সামনে সাহস করে কোন কথা বলতে পারিনি। যে কারণে ঋণের টাকা বিতরণে অনিয়ম হয়েছে।
এই সমিতির ঋণগ্রহীতা সুখরঞ্জন, মরিয়ম বেগম, মো. সাইফুল, ফাতেমা বেগম, নাছিমা বেগম, জিয়াউল হক ও মো. আলমের বাড়িতে কোনো গরু পাওয়া যায়নি। এদের মধ্যে ফাতেমা বেগমের স্বামী সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির। তাদের বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি, মানুষজন থাকেন না। তারা থাকেন চাঁদপুর শহরে। সাইফুল ইসলাম নামে ঋণগ্রহীতা দেখালেন তার ভাইয়ের গোয়াল ঘর।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ঋণ বিতরণের জন্য দুটি সমিতির সদস্য যখন চূড়ান্ত হয়, তখন আমি এই উপজেলায় ছিলাম না। তবে ঋণ বিতরণ হয়েছে আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায়। যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, তাদের বিষয়ে আমরাও তদন্ত করে দেখছি। কেউ কেউ কোরবানিতে বিক্রির জন্য ষাঁড় কিনেছেন।
তিনি আরো বলেন, আমাদের তদন্তে যাদের অনিয়ম পাওয়া যাবে, তাদের বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ, ঋণের ২ লাখ টাকার মধ্যে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও পরবর্তী ৪০ হাজার টাকা চেক বিতরণ অপেক্ষমাণ। এসব বিষয় সামনে রেখে আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম চালাতে হবে।
চাঁদপুর জেলা সমবায় কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, এই ঋণ বিতরণ সম্পর্কে আমি অবগত না। তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। এই ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকলে প্রকল্পের দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানানো হবে। যারা ঋণের টাকা নিয়ে অনিয়ম করেছেন তাদের বিষয়ে পরবর্তীতে নিদের্শনা আসবে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁদপুরের সমবায় ও বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন শেখ বলেন, দুগ্ধ উৎপাদন বাড়াতে সরকারের এই প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঋণ বিতরণ এবং নেওয়ার ক্ষেত্রে যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
এসএএইচ