ঢাকা, শুক্রবার, ৭ ভাদ্র ১৪৩২, ২২ আগস্ট ২০২৫, ২৭ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

একে একে বন্ধ হয়ে গেছে সাতক্ষীরার ১৩ সিনেমা হল, ধুকছে ‘লাবণী’

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৫৩, আগস্ট ২২, ২০২৫
একে একে বন্ধ হয়ে গেছে সাতক্ষীরার ১৩ সিনেমা হল, ধুকছে ‘লাবণী’ দরবার হলের একটি অংশেই রয়েছে লাবণী সিনেমা হল

সাতক্ষীরা: এক সময় শো’র সময় হলে সিনেমা হলের সামনে ভীড় লেগে যেত। এতো দর্শককে জায়গা দেব কোথায়, তা নিয়ে চিন্তায় পড়তাম।

টিকিট না পেয়ে অনেকে ভাঙচুরও করতো। কিন্তু এখন মানুষ আর সিনেমা হলে আসে না। দুইজন-চারজনকে নিয়েও শো চালাতে হয়। এ একটি হলই এখনো টিকে আছে। বাকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট এসে সিনেমা হলের আর কদর নেই।
 
বেশ হতাশার সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী লাবণী সিনেমা হলের ম্যানেজার জারদিসুর রহমান।

জারদিসুর রহমানের কথার সূত্র ধরে তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলায় আগে ১৪টি সিনেমা হল ছিল। এর মধ্যে এখনো ধুকে ধুকে চলছে সাতক্ষীরার সবচেয়ে পুরাতন লাবণী সিনেমা হল। একে একে বন্ধ হয়ে গেছে শ্যামনগরের লক্ষ্মী ও সুন্দরবন সিনেমা হল, কালিগঞ্জের জ্যাকি সিমেনা হল, দেবহাটার লাইট হাউজ ও ইছামতি ছিনেমা হল, কলারোয়ার জোনাকি ও পলাশ সিনেমা হল, আশাশুনির কুল্যার সোনালী সিনেমা হল, পাটকেলঘাটার চ্যালেঞ্জ ও মামুন সিনেমা হল এবং তালার ফাল্গুনী সিমেনা হল।

সিনেমা হলগুলো বন্ধ হওয়ার নেপথ্যে:
ফিতা ক্যাসেটের প্রচলন-ডিশ লাইনের সম্প্রসারণ-ইন্টারনেটের বিস্তার ও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা- বিবর্তনের এ ধারা সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সিনেমা হল কেন্দ্রিক বিনোদনে। এছাড়া মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে, আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত হয়নি দেশের সিনেমা।  

তাই ক্রমেই দর্শক খরায় ভুগতে থাকা সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে একের পর এক। সেই সঙ্গে সাতক্ষীরার রক্সি সিনেমা হল ও সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামের সার্কাস প্যান্ডেলে বোমা হামলার ঘটনাও মানুষকে সিনেমা হল বিমুখ করতে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। এছাড়া সিনেমা হলগুলোর পরিবেশ ও অবকাঠামোগত অনুন্নয়নও বর্তমান প্রজন্মকে সিনেমা হলমুখী করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে লাবণী সিনেমা হলের ম্যানেজার জারদিসুর রহমান বলেন, একটা সময় সিনেমা হল ছিল মানুষের বিনোদনের অন্যতম প্রধান উৎস। মানুষ তখন গ্রাম থেকে দল বেধে সিনেমা দেখতো আসতো। কিন্তু যখন ফিতা ক্যাসেটের প্রচলন হলো, তারপর ডিশ লাইন পৌঁছালো ঘরে ঘরে, আর সবশেষ ইন্টারনেটের বহুল ব্যবহার মানুষকে একেবারেই সিনেমা হল বিমুখ করেছে। এক স্মার্টফোনই ঘড়ি, টর্চলাইট ও সিনেমা হলের ব্যবসায় ধস নামিয়ে দিয়েছে। মানুষের এখন তিন ঘণ্টা এক জাগায় বসে সিনেমা দেখার সময় সুযোগ কিছুই নেই। একইভাবে যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচও উঠে গেছে। ভারতীয় সিনেমা যেভাবে উন্নত হয়েছে, আমাদের তেমনটা হয়নি।  

সাতক্ষীরায় সবশেষ গত ঈদের পরে বন্ধ হয়ে গেছে সঙ্গীতা সিনেমা হল। তারও ১০-১২ বছর আগে রক্সি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যায়। আর জেলার বিভিন্ন উপজেলার অন্যসব সিনেমা হলও বন্ধ হয়ে গেছে এক দেড় দুই দশক আগে।

সাতক্ষীরা জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোসফিকুর রহমান মিল্টন বলেন, ২০০২ সালে সাতক্ষীরার রক্সি সিনেমা হল ও চলমান গুড়পুকুর মেলার সার্কাস প্যান্ডেলে এক সঙ্গে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ওই সময় মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিপর্যয় দেখা দেয়। মানুষ ভয়ে সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সিনেমা হলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যায়।

ধুকছে ঐতিহ্যবাহী লাবণী সিনেমা হল
শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের জন্য ১৯১৩ সালে তৎকালীন জমিদার প্রাণ নাথ রায় চৌধুরীর পারিবারিক আত্মীয় বিনয় কৃষ্ণ ঘোষ ২৯ শতক জমি দান করেছিলেন, যেখানে স্থাপিত হয় দরবার হল। এ দরবার হলে নিয়মিত নাট্য চর্চা ও প্রদর্শনী হতো। এরপর ষাটের দশকে দরবার হলে ‘সিতারা টকিস’ নামে সপ্তাহে পাঁচদিন সিনেমা প্রদর্শনী শুরু করেন মোজাম্মেল হক নামে এক ব্যক্তি। বাকি দিনগুলোতে চলতো নাটক প্রদর্শনী, মাঝে মাঝে রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হতো।  

স্বাধীনতার পরে এসএম রুহুল আমিনের তত্ত্বাবধানে যাত্রা শুরু করে লাবণী সিনেমা হল। জেলার সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী এ সিনেমা হলটি এখনো টিকে রয়েছে। তবে, হারিয়ে জৌলুস।

সিনেমা হলটিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এখন পুরোনো একটি সিনেমার প্রদর্শনী চলছে। নাম ড্যাম কেয়ার। দর্শক পাঁচজন। হলটি টিকিয়ে রাখতে পাঁচজনকে নিয়েই শো চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। দর্শকরা বয়োবৃদ্ধ, তাদের মধ্যে তরুণ প্রজন্মের কেউ নেই।

ম্যানেজার জারদিসুর রহমান জানালেন, বর্তমান প্রজেন্মর কেউ এখন সিনেমা দেখতে আসে না। যারা বৃদ্ধ হয়ে গেছে, কোনো কাজ নেই। তারা সময় কাটাতে আসে। আবার দুই একজন ভ্যানচালক, রিক্সাচালকও আসে।

তবে, এখনো ঈদ কিংবা কোনো উৎসবের সময় হল ভরে যায় দর্শকে। কিন্তু দর্শকের এ চাপ থাকে মাত্র দু/একদিন। পরে আবার যা তাই। এজন্য সিনেমা আনার যে খরচ, তা ওঠে না।

শাকিব খানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভালো সিনেমা আনতে অনেক খরচ হয়, আর সাধারণ মানের সিনেমা আনতে দুই-তিন হাজার টাকা হলেই হয়। মাঝে মাঝে সেই টাকাও ওঠে না।

জারদিসুর রহমান বলেন, এমনিতেই মানুষ এখন হল বিমুখ। তার ওপর পরিবেশ ভালো না করলে মানুষ এখানে কেন আসবে? কিন্তু পরিবেশ ভালো করার উদ্যোগ বা মূলধন ব্যয় করবে কে? এভাবেই যে কয়দিন যায়।

দরবার হল বা লাবণী হল ভেঙে সেখানে বাণিজ্যিক মার্কেট বানানোর স্বপ্ন দেখছে সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদের একটি পক্ষ। এর বিপরীতে সেখানে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রস্তাব করেছেন সাতক্ষীরার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের লোকজন।

তাদের বক্তব্য, আগে সাতক্ষীরা ফ্রেন্ডস ড্রামাটিক ক্লাবের নাট্য চর্চাও একইভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। বহুতল মার্কেট হয়েছে, কিন্তু ড্রামাটিক ক্লাবের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। সেখানে এখন আর নাটক হয় না, বসে জুয়ার আসর।

এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিনয় কৃষ্ণ ঘোষ দরবার হলের জায়গা দিয়েছিলেন থিয়েটার করার জন্য। সেখানে দীর্ঘসময় ধরে থিয়েটার হয়েছে, সিনেমা প্রদর্শনী হয়েছে, সারাদেশের নাট্য দল নিয়ে নাট্য প্রতিযোগিতা হয়েছে। নানা কারণে সব কিছু বন্ধ, এখন শুধু সিনেমা হলটি আছে। এটা ভেঙে মার্কেট করা হলে আর কখনো সিনেমা বা সাংস্কৃতিক কাজে ব্যবহারের সুযোগ থাকবে না। কিছু মানুষের মার্কেটের দোকান বরাদ্দ কেন্দ্রিক বাণিজ্য হবে। তাই এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করতে হবে। যেখানে একটি অংশ থিয়েটার, একটি অংশ আবৃত্তি, একটি অংশ নৃত্য, একটি অংশ আধুনিক সিনে কমপ্লেক্স, একটি অংশ কমিউনিটি সেন্টারও হতে পারে। কারণ এখানে এগুলো হতো, রাজনৈতিক কর্মসূচিও হতো। এখানে মাওলানা ভাসানী প্রোগ্রাম করেছেন, জিয়াউর রহমানও প্রোগ্রাম করেছেন। সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স হলে সংস্কৃতি বিকাশে যেমন ভূমিকা রাখবে, তেমনি মানুষ আধুনিক ও উন্নত পরিবেশে বিনোদনের জায়গাও খুঁজে পাবে।

এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।