দিনাজপুর: মাত্র আট মাস বয়সী কন্যা শিশু আসিফা বিনতে আশা। কখনো মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে চলার চেষ্টা, আবার কখনো মায়ের কোলে উঠে একটু খুনসুটি-সব মিলিয়ে স্বাভাবিক শিশুর মতোই তার দিনযাপন।
আসিফার জন্মের আগেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হন তার বাবা আসাদুল হক বাবু। বড় দুই যমজ বোন খাদিজা ও আছিয়া আছে তার।
মা শারমিন আক্তার পরম মমতায় তিন কন্যাকে লালন-পালন করলেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চারা তাকিয়ে থাকে বাবার পথের দিকে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। ঢাকার যাত্রাবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন চলছিল। অন্যদিকে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগে দেশজুড়ে চলছিল উল্লাস। সেদিন স্বামীকে বারবার ফোন করে সাবধানে থাকতে বলতে চাচ্ছিলেন শারমিন আক্তার। কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছিল না। এক সময় খবর আসে আসাদুল হক বাবুর শরীরে গুলি লেগেছে।
তখন গর্ভে সন্তান নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করেন শারমিন। প্রথমে ছুটে যান মিটফোর্ড হাসপাতালে, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও খোঁজ করেন। একপর্যায়ে লাশের সারির মধ্যেই খুঁজে পান স্বামীর নিথর দেহ। পরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় লাশ নিয়ে যান দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ভান্ডারা ইউনিয়নের পাকুড়া গ্রামে। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে ৬ আগস্ট দাফন করা হয় বাবুকে।
স্বামীর মৃত্যুর শোক না কাটতেই নতুন সংকটে পড়েন শারমিন। ঢাকায় যাত্রাবাড়ীতে ভাড়া বাসায় স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়িসহ একসঙ্গে ভাড়া থাকতেন শারমিন। স্বামীকে দিনাজপুরে দাফন করে শারমিন আক্তার আবার ওই বাসায় গিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামীর অনুপস্থিতিতে এক মাসও শ্বশুরবাড়িতে বা শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে থাকতে পারেননি তিনি। সেখানে আর জায়গা হয়নি তার, তাকে দিনাজপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাই বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেন মায়ের বাড়িতে, সেখানেই জন্ম হয় আসিফার। তবে যমজ দুই মেয়ের মধ্যে আছিয়াকে দাদা-দাদি নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছেন। সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তার শ্বশুর-শাশুড়ি। এমনকি বাসাও বদলে ফেলেছেন তার শ্বশুর-শাশুড়ি।
এক বছর হয়ে গেছে সেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের। স্বামীকে হারিয়ে কেমন আছেন শারমিন আক্তার ও তার পরিবার সেটা জানতে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি বিরল উপজেলার নোনাগাঁও গ্রামে। সেখানেই কথা হয় শারমিন আক্তার ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।
শারমিন আক্তারের নানি রাবিয়া বেগম বলেন, আমার নাতজামাই আন্দোলনে শহীদ হয়েছে। কিছুদিন পর থেকে শারমিন আমাদের বাসায় চলে এসেছে। আমি তো তার বাবা মাকে আমার বাসায় রেখেছি। এখন সেও এসে এখানে থাকছে। তাদের নিজস্ব কোনো জমিজমা বা ঘরবাড়ি নেই। আমি বেঁচে থাকতে ওদের আগলে রাখব। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর কী হবে, কোথায় থাকবে ওরা? আমি চাই সরকারিভাবে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক, যেন সে তার ছোট্ট মেয়েগুলোকে নিয়ে একটু থাকতে পারে।
শারমিনের মা জোছনা বেগম বলেন, তার শ্বশুর-শাশুড়ি কোনো খোঁজখবর রাখেন না। বাচ্চাগুলোর খবরও নেন না। আমি তো মা, মেয়েকে ফেলে দিতে পারি না। কিন্তু আমিও তো আমার মায়ের বাড়িতে থাকি-এখন মেয়েও এসে উঠেছে।
শারমিন আক্তার বলেন, শ্বশুর-শাশুড়ি কোনো যোগাযোগ রাখে না। স্বামীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের সিমকার্ডও বন্ধ করে রেখেছে। ওই নম্বরে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে যোগাযোগ হতো। এতে অনেক সমস্যা হয়েছে। শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের বাড়িতে রাখেননি। আমি তাই আমার মায়ের বাড়িতে চলে আসি। এটা আমার মায়েরও বাসা না। নানির বাড়ি। এখন তো আমার জায়গা জমি ও নাই যে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেব। সরকারি খাস জায়গায় আমার বাড়ির বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখনো তা বেশি দূর গড়ায়নি।
তিনি বলেন, আমার জমজ দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়েকে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের কাছে রেখে দিয়েছে। আমি তাকে আমার কাছে নেওয়ার জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভাইয়েরা, ইউএনও সবাই চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা কথা শোনেনি। আমি চাই, আমার মেয়েটা তো বাবার আদর থেকে বঞ্চিত, কমপক্ষে মায়ের আদর যেন পায়। এজন্য আমার কাছে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আর আমার মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কোথাও যদি একটা বসবাসের জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে অনেক ভালো হতো।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দিনাজপুরের আহ্বায়ক একরামুল হক আবির বলেন, শহীদ আসাদুল হক বাবুর স্ত্রী শারমিন আক্তার এবং তাদের মেয়েদের জন্য আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ এবং সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। তার এক মেয়ে তার দাদা-দাদির কাছে রয়েছে। বেশ কয়েকবার আমরা চেষ্টা করেছি, মায়ের কাছে তাকে ফিরিয়ে দিতে, কিন্তু তার শ্বশুর-শাশুড়ির সেভাবে সহায়তা করেননি। আর জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে যতটুকু সহায়তা দেওয়া দরকার আমরা চেষ্টা করেছি সেটা দিতে। একই সঙ্গে তার বাড়ির বিষয়ে আমরা কথা বলেছি। এছাড়া শারমিন আক্তারের স্থায়ীভাবে কোথাও কাজের ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সেটিও আমরা চিন্তাভাবনা করছি।
বিরল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, বিরল উপজেলায় মোট তিনজন শহীদ রয়েছেন। তাদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। এর মধ্যে শারমিন আক্তার একজন। তিনি যেহেতু ভূমিহীন, তাই তার বাড়ির জন্য আমরা কথা বলেছি। আমাদের উপজেলা থেকে তার বাড়ির প্রস্তাবনাটি জেলা পর্যায়ে পৌঁছানো হবে। একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে এটি হবে। তাই এটি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া উপজেলার পক্ষ থেকে সরকারি যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেন তিনি পান, এ প্রচেষ্টা রয়েছে।
শহীদ আসাদুল হক বাবুর পরিবারকে প্রথম দফায় এক লাখ টাকা দেয় জুলাই ফাউন্ডেশন। যা শারমিন আক্তারের শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের কাছে রেখে দেন। পরে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়। সেখান থেকে এক লাখ টাকা শারমিন আক্তারকে দেওয়া হয়। অবশিষ্ট এক লাখ শ্বশুর বাড়ির লোকজন রেখে দেন। পরে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ১০ লাখ টাকার একটি একটি চেক শারমিন আক্তারকে দেওয়া হয়। দাদা-দাদির কাছে থাকা পিতাহারা সন্তানটিকে যেন শারমিন আক্তারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়- এমনটাই দাবি জানিয়েছেন শারমিন।
এসআই